৩০ বছর তাঁর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার। এর মধ্যে তৈরি করেছেন ৮টি চলচ্চিত্র। যে চলচ্চিত্রগুলোকে কোনো ভুখন্ডের গল্প কিংবা কোনো ধারার চলচ্চিত্রের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। রুপকথার গল্প আ লিটল প্রিন্সেস থেকে শুরু করে, তরুণ-তরুণীদের পথযাত্রা নিয়ে সিনেমা ইয়া তু মামা তাম্বেইন হয়ে চিলড্রেন অব মেন এবং অস্কার জয়ী সিনেমা গ্রাভিটিও আছে এই তালিকায়। প্রত্যেক সিনেমাতেই তিনি নিজেকে ভেঙেছেন। এবং ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজের সৃজনশীলতা। স্যান্ড্রা বুলক ও জর্জ ক্লুনির মতো তারকাদের নিয়ে গ্রাভিটি বানানোর পরে একেবারেই আনাকোড়া অভিনয়শিল্পীদের দিয়ে সাদা কালো সিনেমা রোমা বানানো একমাত্র তাঁকেই সাজে। তিনি আলফনসো কুয়ারন। মেক্সিকোর নামজাদা চলচ্চিত্রকার। কথা বললেন নিজের চলচ্চিত্র ভাবনা নিয়ে।
আপনি আগের সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, মেক্সিকোর সঙ্গে আপনার সকল যোগাযোগ ছিন্ন করেছেন। এটাকে নিশ্চয়ই আপনি নিজেও ভালো হিসেবে দেখবেন না?
এটা খুবই ক্লান্তিকর। এটা ব্যবসার জন্যও ভালো না। আমার প্রথম সিনেমা বানানোর তরিকাটা খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না। মেক্সিকোর সরকার থেকে আমি প্রচুর সাহায্য পেয়েছি কিন্তু তারা চলচ্চিত্রে খুবই সামান্য ব্যয় করে। আমি ভয়ে ছিলাম যে তারা আবার আমার বস হয়ে যায় কিনা। সিনেমাটি আমার অধীনেই ছিল, কারো দয়া চাইতে হয়নি। আমি যেভাবে সিনেমা বানানো পছন্দ করতাম সেভাবেই সিনেমা বানিয়েছি। আমি সচেতন ছিলাম যে আমাকে এই সিনেমার পর আবার সিনেমা বানাতে আসতে হবে। তাই আমি টরোন্টো ফিল্ম ফেস্টিভালে সিনেমাটি নিয়ে যাই। এরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমার কাছে বিভিন্ন প্রস্তাব আসতে শুরু করে।
View this post on Instagram
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
ফলেন অ্যাঞ্জেলস ধারাবাহিকের একটি পর্ব পরিচালনার কথা মনে করতে পারি। আমি একদমই অনিশ্চয়তায় ভুগেছি এবং মনে হয়েছে সবকিছু কেমন অসাড় হয়ে আসছে। কারণ তখন সেটে আমিই ছিলাম একমাত্র অপরিচিত পরিচালক। কারণ অন্য পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন স্টিভেন সোডারবার্গ, জনাথন কাপলান, ফিল জোয়ানু। এমনকি বিখ্যাত তারকা টম ক্রুজ ও টম হ্যাঙ্কসও একটি করে পর্ব পরিচালনা করেছিলেন। যদি টম হ্যাঙ্কস এর জন্য কোনো বিরতির প্রয়োজন হতো তা আমার কাছ থেকে নেওয়া হতো।
আমার মনে হতো, আমাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এ কারণে আমি আমার পছন্দের কয়েকজন অভিনয়শিল্পীর কাছে কৃতজ্ঞ। অ্যালান রিকম্যান ও লরা ডার্ন তাদের মধ্যে অন্যতম। কারণ তাঁরা যখন আমার এ অবস্থা দেখল, তাঁরা বলল, ব্যাপার না। আমরা তোমার জন্য আছি। আমরা চাই তুমি আমাদের পরিচালনা কর। তুমি যা বলবে আমরা সেভাবেই অভিনয় করব। এমন আচরণে আমি সাহস ফিরে পাই। আমি পুনরায় কাজ শুরু করি। এবং ধারাবাহিকটির মধ্যে আমার পরিচালিত পর্বটিই প্রচুর পরিমাণে পুরস্কার জিতে নেয়। এটা ছিল তখনকার আমার, রিক ও লরার মধ্যে বন্ধুত্বের একটি উদাহরণ।
যখন আমি প্রথম হলিউডে আসি তখন আমাকে এমন একজন মেক্সিকান হিসেবে ধরা হতো যারা এই মেক্সিকান প্রজন্ম নয়। আমাদের প্রজন্মের মেক্সিকোকে দেখা হতো উগ্র হিসেবে। আমি মেক্সিকোতে বড় হই পিআরআই ইনস্টিটিউশনাল রিভ্যুলোশনারি পার্টির তখন রমরমা অবস্থা। উগ্র জাতীয়তাবাদে সবকিছু মেক্সিতে নিষিদ্ধ ছিল। মেক্সিকোর ভেতরের কোনো জিনিস বাইরে যাবে না, তেমনি বাইরের কোনো জিনিসও ভেতরে আসতে পারবে না।
আমি মেক্সিকান তাই আমার মনে অনিশ্চয়তা ছিল এমনটি নয়। অনিশ্চয়তার কারণ ছিল সেখানকার আদর্শ। এখন মেক্সিকোতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এই প্রজন্ম কোনো সীমান্ত মানে না। এটা খুবই সাধারণ তাদের জন্য। আমি তাদের এ কারণে সম্মান করি। তাদের মধ্যে কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। এখান থেকে আমার অনিশ্চয়তা আর বাড়তে পারেনি।
গ্রেট এক্সপেক্টেশনস সিনেমায় আমি সিনেমার যন্ত্রপাতি দিয়ে মুগ্ধ ছিলাম। কিন্তু যন্ত্রপাতি দিয়ে তো সিনেমা হয় না। তার মূল্যও আমি পেয়েছি। এই সিনেমাটি আমি আসলে ঠিকভাবে বুঝিনি। আমি ভাবছি, যদি আমি ভিজ্যুয়াল ব্যাপারগুলো ব্যবহার করি সেগুলো খুব বেশি কাজ করবে কিনা সে বিষয়ে আমার জ্ঞান ছিল না। আমি এ সমস্যাটি বুঝতে পারি। এবং পরবর্তী সিনেমা ইয়ে তু মামা তাম্বেইন বানাই। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি ধারা তৈরি করি। আমি গ্রেট এক্সপেক্টেশন সিনেমাতে যন্ত্র দিয়েই সবকিছু করতে চেয়েছিলাম।
View this post on Instagram
আমি ভাবার চেষ্টা করি যে, কীভাব একটা সিনেমা আমি বানাবো। কিন্তু যদি আমি জেনে যাই যে, এভাবে সিনেমাটি বানানো হবে, তবে আমার আগ্রহ কমে যায়। যদি আমি জানি কীভাবে সিনেমাটি তৈরি হবে তাহলে আমি বিরক্ত হয়ে যাই। কিন্তু অজানা কিছু একটা বানাবো এটা আমাকে অনেক বেশি আগ্রহী করে তোলে। একটা চলচ্চিত্র বানাতে আজানাকে জানার আগ্রহই বেশি আমাকে চালিত করে। কিন্তু আসলেই আমি জানি না কীভাবে এটি ঘটে যায়। এ কারণেই আমার সিনেমাগুলো একটি আরেকটির থেকে আলাদা হয়।
প্লটের থেকেও আমি এই সিনেমায় পুরো সিনোম্যাটির অভিজ্ঞতা দেখেছি। অধিকন্তু এটা ছিল সে ধরনের কাজ যা সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতা ডিমান্ড করে। সব সময়ই আমি যখন কোনো নতুন সিনেমা শুরু করি। আমি বলি এটা খুবই সাধারণ একটি সিনেমা। এটা হবে খুবই সাধারণ। আমি খুব দ্রুত নির্মাণ করি। আমার প্রযোজক সবসময় এটাই বলে।গ্রাভিটি সিনেমার জন্য আমি ইমানুয়েলকে বলেছিলাম সিনেমাটি তুমি যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি এবং খুব সহজে তৈরি কর। এটা ছিল স্পেস সেন্টারে একজন নারীর বিচরণ। সুতরাং আমরা শুধু কালো কাপড়রের একটি ব্যাকগ্রাউন্ড ব্যবহার করেছিলাম। তার সঙ্গে ছিল কিছু ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট। এটাই। যখন আমি রোমা শুরু করি। আমার প্রযোজককে বলেছিলাম এটা খুবই ছোট এবং ব্যক্তিগত সিনেমা। এবং আমার এ কথা কিন্তু মিথ্যা না। কিন্তু যখন আমি কোনো প্রকল্পের জন্য প্রস্তুতি নিই, বাস্তবতায় আসলে এটা শোআপ হয়ে যায়।এটা অবশ্য একটা বড় প্রযোজনা দেখার সুযোগ করে দিয়েছে যেটা মেক্সিকো শহরকে দেখালো…
যদিও আমি এটাকে দেখাতে চাইনি। সিনেমার মধ্যে সর্বজনীন বিষয়টি অবশ্যই ফোকাস হওয়া উচিত। পুরো ধারনাটির মাধ্যমে আমি আপনাকে মহাবিশ্বের মুখোমুখি করতে চেয়েছি।
হ্যা। আমি ১২ বছর আগে এই বিষয়ের উপর একটি সিনেমা বানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জীবন চলতে থাকে। কিছু জিনিস আছে যার উপর আপনার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। যে কারণে আমি সিনেমাটি বানাতে পারিনি। আমার বিশ্বাস এটাই ভালো সময় ছিল। যদিও আমি এই বিষয়টির জন্য অতটা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ছিলাম না। কিন্তু রোমার মধ্যের আনেক কনটেন্টই আগের ভার্সনে ছিল
ফেলিপে তখন এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছিল। যদিও তখন এটি নিয়ে বলার সুযোগ কম ছিল। ফেলিপে অবশ্যই সেখানে সরাসরি না বলে রূপক আকারে দেখিয়েছিল। এবং তিনি সমগ্র মোক্সিকোর সামাজিক-রাজনৈতিক কনটেক্সটকে দেখিয়েছিলেন।
রোমা কি কানোয়ার কাছে ঋণী?
রোমায় আমি সচেতনভাবেই কোনো কিছুর প্রভাব ও সূত্রগুলোকে এড়িয়ে গিয়েছি। এটা খুবই কঠিন। কারণ আমি সবসময়ই সিনেমা তৈরির সময় অন্য সিনেমাগুলো নিয়ে ভাবি। আমি কতগুলো সিনেমা দেখেছি অনুপ্রেরণা নেওয়ার জন্য। যদিও সেগুলো ছিল এই সিনেমা থেকে একেবারেই আলাদা। আমি আসলে চাই দর্শকের সঙ্গে একটি আবেগের রাস্তা তৈরি করতে এবং একটি ভাষা তৈরি করতে যা-ই আমি করতে চাই না কেন। আমি রোমায় কোনো কিছুর প্রভাব থাকুক এটা চাইনি। কারণ আমি দরকার আমার বিষয় নিয়ে বিশ্বাসী থাকা আমার স্মৃতিগুলোকে পুনরায় জীবিত করার জন্য। যখন আমি একটা শটের ফ্রেম তৈরি করি আমি আমার ভেতরের ব্যাপারগুলোকে স্মরণ করি। এবং আমি দেখতে পাই যে, এটা একটা বিষয় যা সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছিল যে সিনেমাগুলোকে আমি ভালোবসি।এবং যখন আমি আমার দৃশ্যগুলো দেখি, আমি আবিষ্কার করি এটা আসলে ওইসব সিনেমার রেফারেন্স ছিল। তখন আমি ভাবি, আমি যা চেয়েছি এটা তা নয়। রোমার প্রযোজনা নকশাকার আমাকে বলেছিল, এটা সুন্দর দৃশ্য। আমি বলেছিলাম, এটা সুন্দর, কারণ এটা অন্য কেউ করে আমাদের চোখে সুন্দর বলে লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এটা এই সিনেমার জন্য নয়। অন্য অনেকগুলো শট অনেক ভালো হতে পারে কিন্তু এই সিনেমার জন্য আমাদের তৈরি করা শটই হলো ঠিক। এতে এটা প্রমাণিত হয় না যে, এখানে কোনো কিছুরই রেফারেন্স ছিল না। কারণ জীবনই হলো যা তুমি ধারণ কর। আর সিনেমাতে তুমি সেটাই যা তুমি দেখ, পড় এবং শোনো, এবং এটা শুধু সিনেমার জন্যই নয়।
View this post on Instagram
প্রত্যেক মানুষের অভিজ্ঞতা তাঁর একটি দীর্ঘ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যখন আপনি একটি চাকরি শুরু করেন তখন গড় কাজের থেকে এটাকে অনেক লম্বা মনে হয়। পাশাপাশি দুটো বাস্তবতা এগিয়ে চলে। প্রত্যেকটা বাধা-বিপত্তি আপনার প্রকল্পকে এক ভিন্ন ধরনের গতি তৈরি করে। এটা ভিন্নভাবে চলে। এবং যখন আপনি সেই বাস্তবতার সঙ্গে পুনরায় মুখোমুখি হন তখন আপনি ভিন্ন কিছু অনুভব করেন। কখনো কখনো এই ভিন্নতা রুপান্তর সৃষ্টি করে। কখনো কখনো এটি ধাক্কা খাওয়ার মতো, কিন্ত এটাই আরকি। রোমা সিনেমায় নির্দিষ্ট করে আবেগি দৃশ্যের মাধ্যমে যে কোনো মানুষের অভিজ্ঞতাকে তাঁর নিজস্ব স্মৃতির মাধ্যমে ফোকাস করে দেখানো হয়েছে।
না বিশ্ব শুধুই পরিববর্তন হচ্ছে তা নয়, অবশ্যই আমরা পরিবর্তিত হচ্ছি। বিশ্বের কী পরিবর্তন হচ্ছে এটার আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। রোমা সিনেমায় প্রত্যেকেই একটি বিষয়ের দিকে ফোকাস থাকবে। তা হলো-তাদের নিজেদের স্মৃতি দিয়ে কিছু একটা আবিষ্কার করা। এটা হতে পারে সুখের কিংবা বিষাদময়। স্মৃতির মুখোমুখি হওয়া মানে হলো পেছনে যা ফেলে এসেছেন অবচেতন মনে তার সঙ্গে বাস করা।রোমা ছিল স্মৃতির সঙ্গে তিন বছরের বসবাস। শুধু বসবাসই নয়, স্মৃতির গোলকধাঁধার দরজা খুলে দেওয়া। যত তাড়াতাড়ি আপনার দরজা খুলবে আপনি পাবেন নতুন ঘর সাথে আরও নতুন দরজা। এবং সবসময়ই আপনি পাবেন স্মৃতির নতুন দরজা এবং নতুন ঘর।
Leave A Comment