ইরানের যে কয়েকজন নির্মাতা গোটা বিশ্ব চলচ্চিত্রকে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্যে একজন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। তাঁর ছবিতে পাওয়া যেত ইরানের অপূর্ব কাব্যের ছোঁয়া। বেশ কয়েক বছর আগে নিজের জীবন ও চলচ্চিত্র নিয়ে কথা গণমাধ্যমের কাছে কথা বললেন এই নির্মাতা।
না। আমি মনে করি এক ঘরানার চলচ্চিত্রকার অন্য ঘরানার চলচ্চিত্র দেখতে খুবই আনন্দ পান। যেমন ধরুন, আমি দ্য গডফাদার-এর মতো জনপ্রিয় সিনেমা দেখতে পছন্দ করি ও মজা পাই। কিন্তু মানুষ এটি শুনে আঁতকে উঠে।
এটাই তো সিনেমার সৌন্দর্য্য (হাসি)!আপনার কি মনে হয়, সিনেমা আন্তর্জাতিক হওয়া উচিত?
প্রত্যেক সিনেমারই তাঁর নিজস্ব জন্ম পরিচয় আছে। সিনেমা মাত্রই মানুষের জীবন, মানবিকতা। বিশ্বের প্রত্যেক আলাদা আলাদা দেশে কেবল ধর্ম, ভাষা ও জীবন-যাপন পদ্ধতি আলাদা, বাকি সবকিছুই এক। যা আমাদের সকলের আশে পাশেই আছে। আমরা যদি মানুষের ভেতরকে এক্সরে করি, তাহলে তাদের বিভিন্ন ভাষা ও জাতিভেদকে উঠিয়ে আনতে পারব না। আমাদের শরীরের রক্তসঞ্চালন হয় একই ভাবে। আমরা নার্ভাস হই একই রকমে। আমাদের চোখ একইভাবে কাজ করে। আমরা একইভাবে হাসি-কাঁদি। আমরা কষ্টও পাই একইভাবে। আমাদের জাতীয়তা ও জাতিভেদ কী? তাতে কিছুই যায় আসে না। আমাদের সবার দাতের পাটি কিন্তু একই। আমরা যদি সিনেমাকে ভাগ করে ফেলি, কিংবা সিনেমার বিষয়কে ভাগ করে ফেলি, তাহলে আমরা আলাদা দেশের আলাদা আলাদা ইমোশনগুলোকেও ভাগ করে ফেলব। এটা সম্ভব না। এগুলো সব দেশে একই রকম।
আপনার ছবির চরিত্র কিংবা গল্প, কোনোটাই পরিপূর্ণ তথ্য দেয় না। কারণ আপনি বলেছেন, দর্শকের দেখাও একটা সৃজনশীল প্রসেসেরই অংশ। যার কারণে আপনার ছবি থেকে আমরা একেকজন একেক জিনিস বুঝি। সুতরাং আপনার ছবি থেকে একেকজন দর্শক তার নিজস্ব বোঝাপড়া তৈরি করে। আপনি কী করে বলতে পারনে যে, আমরা সবাই আসলে একই ধরনের আবেগ অনুভূতি নিয়ে চলি?
আপনার প্রশ্নটি খুবই কঠিন। মানুষের মধ্যে নানা ধরনের আইডিয়া কাজ করে। আমি চাই না, সকল দর্শকের একই ভাবে আমার ছবিটি দেখা উচিত। ঠিক যেমন ক্রসওয়ার্ড পাজল। সবাই একই রকমভাবে দেখে। কিন্তু সমাধান করে আলাদাভাবে। আমি সিনেমাতে দর্শকের জন্য কিছু জায়গা ছেড়ে দেই। সুতরাং মানুষ সেটি পূরণ করে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। আমি ভাবি, শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সংগীত, কবিতায় বিমূর্তকে গ্রহণ করতে পারি। সিনেমায় কেন নয়? আমি মনে করি, সিনেমা হলো সপ্তম শিল্প। এটা হাতে পারে সবচেয়ে পরিপূর্ণ শিল্প, কারণ এর মধ্যে সবধরনের শিল্প সমন্বিত আছে। কিন্তু দিন দিন এটা হয়ে উঠছে শুধুই গল্প বলা, শিল্প নয়, যা হওয়া উচিত ছিল।
প্রত্যেক সিনেমাতেই কোনো না কোনো ধরনের গল্প থাকা উচিত। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই গল্পটি কীভাবে বলা হলো। এটা কাব্যময় হওয়া উচিত, এবং ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার মতো সম্ভাবনা থাকা উচিত। আমি এমন কিছু সিনেমা দেখি, যা আমাকে আকর্ষণ করে না। কিন্তু যখন আমি সেগুলো দেখি, তখন এক ধরনের ভাবনা তৈরি হয় আমার মধ্যে। ওই ছবিগুলোতে কিছু মুহূর্ত পাওয়া যায়, যা আমাকে অন্য এক জানালা খুলে দেয়। যা আমার কল্পনাকে বেশ অনুপ্রাণিত করে। আমি অনেক সিনেমা মাঝখানে বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ আমি বুঝে ফেলেছিলাম যে, এর শেষ কী হবে। আমি সিনেমাটিকে তখন পরিপূর্ণ ভাবি। যদি আমি এটা নিয়ে লম্বা সময় ধরে কাজ করি, তবেই আমি ধরা খেয়ে যাব। কারণ এটা আমাকে বিচার করতে বসাবে সিনেমার কোন চরিত্রটি ভালো, কোনটি খারাপ এবং তাদের মধ্যে কী হতে চলেছে। আমি আমার মতো করে সিনেমা শেষ করতে ভালোবাসি।
একদম। আমি মনে করি সিনেমা হলো কাব্যময়। শুধুই গল্প বলা সিনেমার কাজ নয়। আমার লাইব্রেরিতে গল্পের বই ও উপন্যাস দেখবেন একদম নতুনের মতো। কারণ ওগুলো আমি একবারই পড়ি। কিন্তু আমার কবিতার বই পড়ে আছে ঘরের বিভিন্ন কোনায়। কারণ কবিতা আমি পড়তেই থাকি, পড়তেই থাকি। কবিতা সবসময়ই বাস্তবতা থেকে একটু দূরের জিনিস। কবিতাকে আয়ত্ব করা কঠিন। প্রত্যেক বার আপনি যে অবস্থায় থেকে কবিতা পড়বেন, আপনার ভেতরে কবিতার অর্থ ওইভাবেই ধরা দেবে। আপনার পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে কবিতার মর্মার্থ পাল্টে যাবে। আপনার কাছে একই কবিতা একেকবার একেকরকম করে ধরা দেবে। তবে হ্যাঁ, সব উপন্যাস একরকম নয়। এমন কিছু গল্প আছে, যার মধ্যে কাব্যময়তা আছে। যেমন কত কবিতা আছে, মনে হয় যেন একটা উপন্যাস। আমাদের ছোট সময় কবিতা মুখস্ত করানো হতো। এর মাধ্যমে কি আমাদের কবিতা বোঝানো হতো? না। এর মাধ্যমে আমাদের মননকে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হতো।কাব্যময় ধারার ছবির সঙ্গে অন্য ছবির পার্থক্য হলো, অন্য ছবি এক থেকে দুই বার দেখলেই দর্শকেরা বুঝতে পারেন। কিন্তু কাব্যময়ী ছবি বারবার দেখতে হয়। যদিও দর্শকেরা বার বার একই সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত নয়। এটা কে কি আপনার সমস্যা মনে হয় না? আপনি কি চান মানুষেরা আপনার ছবি বার বার দেখুক, কিংবা অন্তত এটা আপনি আশা করেন, তাঁরা আবার দেখবে?
যদি আমি বলি, আমার সিনেমা দর্শকের একবারের বেশি দেখা উচতি, তবে আমি অবশ্যই স্বর্থপর হয়ে উঠব। এটা বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, আমি এইভাবে আমার ছবির প্রচার করছি। আমি সত্যিই বলতে পারি না, কেন আমি এভাবে ছবি নির্মাণ করি। আমার কাছে মনে হয়, আমি এভাবেই ছবি বানাতে জানি, তাই। যখন আমি ছবি বানানোর কাজে থাকি, তখন আমি মোটেও ভাবি না এটা কীভাবে শেষ হবে। ভাবি না যে, মানুষ এটা কয়বার দেখবে কিংবা দেখার পরে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে। আমি শুধু বানাই। এবং আমি এই শিল্পযাত্রার মধ্যে বাস করি। কিছু কিছু আমার পছন্দসই হয় না! যাই হোক আমি শুধু এই একটা জিনিসই জানি। অনেক দর্শক অতৃপ্তি নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আসে, কিন্তু তিনি আমার সিনেমাকে ভুলতে পারেন না। আমি জানি, তাঁর পরবর্তী রাতের খাবারের সময়ে সিনেমাটি নিয়ে সে আলোচনা করবে।
আপনাদের ছোট একটি দল আছে। যারা একটি নির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শ অনুযায়ী চলচ্চিত্র তৈরি করেন। যারা দর্শকদেও শিক্ষিত করার কাজটিও করছেন। এই রকম একটি চ্যালেঞ্জিং ধারার সিনেমাকে কতটা গ্রহণ করা যায়। পাশাপাশি একটি সিনেমা অল্প বোঝার মধ্য দিয়ে কতটুকু আপনার কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া যায়?
আমি বিশ্বাস করি এখন যে সিনেমাগুলো আছে, সেগুলো ২০ বছর আগেও ছিল না। এখনকার সিনেমাগুলো দেখতে দেখতে দর্শকেরা ক্লান্ত। তাঁরা ভিন্নকিছু দেখতে চায়। ইরানে এই ধরনের সিনেমাগুলো মাত্র একটি সিনেমা হলে দেখানো হয়, আর আমেরিকাতে দুটি সিনেমা হলে দেখানো হয়। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট। কারণ বেশিরভাগ মানুষ সহজ কিছু চায়। তারা রোমাঞ্চকর অনুভূতি চায়। তারা চায় হাসতে, কাঁদতে। এবং আমরা কাব্যময়ী সিনেমা থেকে একই স্তরের উতসাহ আশা করতে পারি না। আমি আমার কাজকে তাদের সঙ্গে তুলনা করছি না। কিন্তু আপনি যদি ক্যান্ডিনস্কি অথবা ব্রাক অথবা পিকাসোর কোনো পেইন্টিং পার্কে বিক্রি করেন। কত লোক সেগুলো কিনবে? দাম ১০০ ডলারের মধ্যে হলেও। কারো কাছে অবশ্যই কেবল শিল্পের জন্যই প্রত্যাশা থাকা দরকার, যা বিনোদনের বিপরীত। সাধারণ মানুষ শুধু একটা ছবির জন্য টাকা দেবে না, যদি সে না বুঝতে পারে শিল্প কী। এটা কী বলছে।
আপনার চিন্তার কাছাকাছি আসলে আমিও ভেবেছিলাম। কবিতা আসলে কোনো সরাসরি তথ্য দেয় না। কিন্তু আমাদের নিজস্ব চিন্তাকে শুরু করার পথ বাতলে দেয়।
আমি একমত। কাব্যময়ী ছবিগুলো ধাঁধার মতো। এখানে আপনি দুটি খ- চিত্র একসঙ্গে পাবেন। যার একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। আপনি এটাকে আপনার মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারেন। এটা সাধারণ দর্শক যাতে অভ্যস্ত তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এটা কোনো পরিস্কার ফলাফল দেয় না, এবং কোনো উপদেশও দেয় না।
হোউ সিয়াও-সিয়েনের নাম বলতে পারি। তারকোভস্কির সিনেমা তো শারিরিক জীবন থেকেই আমাকে আলাদা করে দিয়েছে। ফেলিনির সিনেমাগুলো অসাধারণ আধ্যাত্মিক। যেন ছবির মধ্যে স্বপ্নের জীবন নিয়ে আসে। থেয়া অ্যাঞ্জেলোপৌলসের সিনেমাও আধ্যাত্মিক।
শুটিং স্পটে বসেই সংলাপ তৈরি করার সুবিধা হলো, আমার কাছে মনে হয়, এটাই একমাত্র পথ অপেশাদার অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার। এবং আপনি দেখবেন সিনেমার মধ্যে এমন কিছু মুহূর্ত আছে যেগুলো আমার নিজেকেই আশ্বর্য করে তোলে, অন্যদেরও। কারণ এটি কল্পনার বাইরের ছিল। আমি কাউকে কোনো সংলাপ দেই না। কিন্তু দৃশ্যটা বুঝিয়ে দেই। সে যখন এটা নিয়ে সংলাপ বলা শুরু কওে, অসাধারণ দৃশ্য তৈরি হয়। যা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল। এটা এক প্রকার বৃত্তের মতো। এটার কোথায় শুরু, কোথায় শেষ, কিছুই বোঝা যায় না। আমি জানি না, আমি কি ওদের শেখাব, কী বলতে হবে? নাকি ওরা আমাকে শেখাবে কী আমি এখান থেকে নেব?সাক্ষাৎকারটি ফিল্ম কমেন্ট সাময়িকীতে ২০০০ সালের জুলাই-আগস্ট সংখ্যায় বোরোয়। এটি নিয়েছেন ডেভিড স্টেরিট।
Leave A Comment