হালের ক্রেজ ওটিটি প্লাটফর্ম যখন ক্রাইম থ্রিলার আর রোমান্টিক ড্রামার জ্বরে ভুগছে তখন পঞ্চায়েতের মতো কমেডি ড্রামা মুক্তির পর থেকেই এ নিয়ে বেশ হৈ চৈ। এখন পর্যন্ত আইএমডিবিতে ৮ দশমিক ৯ রেটিং নিয়ে আলোচনার তুঙ্গে আছে দা ভাইরাল ফিভার (টিভিএফ) প্রযোজিত ওয়েব সিরিজটি।

গতানুগতিক অ্যাকশন আর রোমান্টিক ধারার বাইরের এমন সিরিজ নিয়ে লিখেছেন খান মাহমুদ

পঞ্চায়েতের বিশেষত্ব হলো ‘সরলতা’। এই সরলতা কাহিনীর। মেদহীন চিত্রনাট্য আর প্রতিটি চরিত্রের দুর্দান্ত অভিনয় ওয়েব সিরিজটিকে উপভোগ্য করে তুলেছে।

নার্ভকে চাপে রাখা থ্রিলার আর করপোরেট আবেগের রোমান্টিকতার বাইরে পঞ্চায়েত নিয়ে যায় শেকড় পোতা স্থানে। যেখানে সকাল সকাল চাপকলে পানির জন্য কলসের সারি আছে, দিগন্তজোড়া মাঠ, হাল চাষ, নির্মল বাতাস আর রাতে নিকষ অন্ধকারে মশার কামড়, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। গ্রামীণ জনপদের এসব বিষয়ই মূলত এক শ্রেণির দর্শকের নজর কেড়েছে।

সম্প্রতি সিরিজটির দ্বিতীয় সিজন প্রকাশ পেয়েছে। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে ফ্ল্যাশব্যাকে প্রথম সিজনের আলাপ হয়ে যাক।

প্রথম সিজনে দেখা গেছে সদ্য গ্র্যাজুয়েট এক যুবক অপশনাল হিসেবে রাখলেও পরে বাধ্য হয়েই পঞ্চায়েত সচিবের চাকরি নেয়। ভারতের উত্তর প্রদেশের ফুলেরা গ্রামে পঞ্চায়েত সচিবের চাকরিতে যোগ দেন শহরে বড় হওয়া অভিষেক ত্রিপাঠি। চাকুরিতে যোগ দেওয়ার প্রথম দিন থেকে তাঁর নিত্যদিনের জীবনে যুক্ত হয় লোডশেডিং, পানির সমস্যা আর তীব্র নিঃসঙ্গতা। তারপর নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা মিলিয়ে পঞ্চায়েত প্রধান পতি ব্রিজ ভূষণ দ্যুবে, উপপ্রধান প্রহ্লাদ পাণ্ডে ও অফিস সহকারি বিকাশের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে অভিষেক ত্রিপাঠির। ধীরে ধীরে গ্রামের জীবনকে গ্রহণ করতে থাকেন অভিষেক। পাশাপাশি এমবিএর প্রস্তুতিও নিতে থাকেন ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে।

দ্বিতীয় সিজনেও এই ঘটনাক্রমকেই টেনে নেওয়া হয়েছে। এখানে দেখা যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অভিষেক ত্রিপাঠির অভিযোজন। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে লঘু উত্তেজনা। পুরোনো রাগকে কেন্দ্র করে খলচরিত্র ভূষণ শর্মা ওরফে বনরাক্ষসের বিভিন্ন কূটচাল আর এসব ঘিরে উত্তেজনার ছোঁয়া দেখা গেছে বিভিন্ন সময়। এরই মধ্য দিয়ে দেখা যায় পঞ্চায়েত প্রধানের মেয়ে রিংকির সঙ্গে অভিষেক ত্রিপাঠির সম্পর্কের আভাস।

 

স্থানীয় এমএলএ চন্দ্রকান্ত মিশরার রাজনীতি এবং তা ঘিরে তৈরি হওয়া উত্তেজনা একেবারে খাপ খেয়েছে পুরো চিত্রনাট্যে। তবে, শেষে ছিল অপ্রত্যাশিত কিন্তু হৃদয় ছোঁয়া ঘটনা। বিপত্নীক উপপ্রধান প্রহ্লাদ পাণ্ডের একমাত্র ছেলে সেনা সদস্য রাহুল পাণ্ডের মৃত্যু। স্পয়লার ছাড়া মোটামুটি এই হলো পঞ্চায়েত ওয়েব সিরিজের গল্প।

 অভিনয়

প্রধান চরিত্র অভিষেক ত্রিপাঠির নাম ভূমিকায় জিতেন্দ্র কুমার একদম টপনচ অভিনয় করেছেন। পুরো চরিত্র নিজে ধারণ করেছেন। সাবেক আইআইটিয়ান এই অভিনেতা এর আগেও তার অভিনয়ের জন্য আলোচিত হয়েছেন। টিভিএফের আরেক ওয়েব সিরিজ ‘কোটা ফ্যাক্টরি’র কল্যাণে তিনি ‘জিতু ভাইয়া’ নামেও পরিচিত। তবে, এখন বোধহয় তিনি ‘সচিব জী’ নামেই পরিচিত হবেন। মূলত, দর্শক তাঁর মধ্য দিয়েই ফুলেরা গ্রামকে ‘এক্সপ্লোর’ করবে বলে মনে হয়েছে। কারণ, অভিষেক ত্রিপাঠিই শহুরে দর্শকদের প্রতিচ্ছবি।

‘প্রধান জী’ নামে পরিচিত হওয়া প্রধান পতি যিনি তাঁর স্ত্রীর বদলে নিজেই পঞ্চায়েত চালান তিনি হলেন ব্রিজ ভূষণ দ্যুবে। এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্বনামখ্যাত রঘুবীর জাদব। তিনি অবশ্য প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে বেশ পরিচিত। প্রধান চরিত্রে রঘুবীর জাদব ১০/১০ পেতেই পারেন। তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দীর্ঘদিনের পুরোনো বান্ধবী নিনা গুপ্তা। দিল্লি স্কুল অব ড্রামা থেকে তাঁদের বন্ধুত্ব। দীর্ঘদিন পর জুটি গড়ে দুজনেই মাতিয়েছেন পঞ্চায়েতকে।

মঞ্জু দেবী চরিত্রে অভিনয় করা নিনা গুপ্তা কাগজে কলমে পঞ্চায়েত প্রধান হলেও চালান তাঁর স্বামী। তিনি সংসার সামলানোর পাশাপাশি বাহিরেও প্রয়োজনমত দ্বায়িত্ব পালন করেন। প্রথম সিজনে যখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর স্বামীকে প্রধান পতি হয়েও প্রধান হওয়ার জন্য জেরা করছিলেন সে সময় ত্রাতার ভূমিকায় হাজির হন মঞ্জু দেবী। আড়ালে থাকলেও তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে আলো টেনেছেন নিজের দিকে। দ্বিতীয় সিজনের শেষদিকে এমএলএর কথার প্রতিবাদ স্বরূপ তাঁর গাড়ি বহর আটকে দেওয়ার অংশটা বিশেষভাবে মঞ্জু দেবীর কঠোর চরিত্রকে সামনে নিয়ে আসে।

উপপ্রধান প্রহ্লাদ পাণ্ডে ভূমিকায় অভিনয় করা ফয়সাল মালিক তাঁর চরিত্রে শতভাগ সার্থক। ফয়সাল মালিককে ভালোভাবে চিনতে পারবেন ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ থেকে। সেখানে পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করা ফয়সাল পঞ্চায়েত সিরিজের পুরোটা সময় হাস্যরসে মাতিয়ে রাখেন প্রহ্লাদ পাণ্ডের চরিত্র দিয়ে।

প্রথম সিজনেই অফিস সহায়ক বিকাশ চরিত্রে অভিনয় করা চন্দন রয় লাইমলাইটে এসেছিলেন। সে সময়ই তাঁর অভিনয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে প্রচুর। একদম গ্রামীণ যুবকের ছাঁচে নিজেকে গড়িয়ে নিতে তিনি শতভাগ সফল। তবে, এই সিজনে তাঁর জায়গায় আলো কেড়েছেন বনরাক্ষস ওরফে ভূষণ শর্মা চরিত্রে অভিনয় করা দুর্গেশ কুমার।

 

 

খেয়াল করুন

পঞ্চায়েতের টেকনিক্যাল দিকও সমালোচনা উৎরে যায় বলেই আমার ধারণা। বিশেষ করে ‘টু-শট’ গুলোর প্রত্যেকটাই গ্রামাটিক্যালি কারেক্ট এবং ফ্রেমিং টপনচ বলেই মনে হয়েছে। কালার গ্রেডিংও চমৎকার। মেকিংয়ের বাইরে পঞ্চায়েতের কিছু দৃশ্য মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।

দ্বিতীয় সিজনের প্রথম পর্বে গ্রামে যাত্রায় নাচতে আসা আহত মেয়েকে নিয়ে ফার্মেসীতে যান সচিব। সেখান থেকে বের হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করার সময় মেয়েটাকে নাচ ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন অভিষেক ত্রিপাঠি। মেয়েটা পাল্টা প্রশ্ন করে সচিব তার নিজের কাজ পছন্দ করে কি না। উত্তরে ‘না’ বলার পর মেয়েটা বলে, ‘তাহলে আপনিও তো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেচে যাচ্ছেন। আসলে, আমরা সবাই কোথাও না কোথাও আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেচে যাচ্ছি।’

আবার অভিষেক ত্রিপাঠি যখন বলেন, ‘বন্ধু বললেই কেবল বন্ধু হয়ে যায় না প্রধান জী। বন্ধু হওয়ার দ্বায়িত্ব, কর্তব্যও পালন করতে হয়।’ এই সংলাপটাও দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়েছে। তবে সবচে বেশী করুণ এবং বাস্তব সংলাপ ছিল শহীদ সেনাসদস্য রাহুল পাণ্ডের সৎকার কভার করতে আসা ক্যামেরা পারসন আর সাংবাদিকের আলাপ। ‘স্যার, সিপাহী পদে চাকরি করা বেশিরভাগ যুবক তো এই গ্রামগঞ্জ থেকেই যায়।’ ‘হ্যাঁ, ২০-৩০ হাজার টাকা বেতনে জীবন দেওয়ার মতো লোক আর কোথায় পাওয়া যাবে!’

 

লেখক: খান মাহমুদ, শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়