‘মনপুরা’, ‘স্বপ্নজাল’ আর ‘পাপ পুণ্য’ এই তিন ছবি দিয়ে নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘লাভ ট্রিলজি’।
সেন্সর সনদ পাওয়ার পরে ‘পাপ পুণ্য’ প্রথমে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভালোবাসা দিব উপলক্ষ্যে। তারপর পিছিয়ে ঈদে এবং শেষে তা পিছিয়ে আনা হয় ২০ মে।
দেশের বিশটির মতো হলে ও দেশের বাইরে উত্তর আমেরিকা, কানাডা ও আমেরিকায় মুক্তি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিবেশক স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো জানিয়েছে, প্রথম সপ্তাহে উত্তর আমেরিকার ৯১টি, কানাডায় ৭টি ও আমেরিকায় ৮৪টি হলে মুক্তি পেয়েছে।
একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি ছবিটি। ২০১৭ সালের কথা, ‘স্বপ্নজাল’ ছবির কাজ চলাকালীন এক বন্ধুর মুখ থেকে গল্পটি শোনেন নির্মাতা। সিনেমা তৈরির ভাবনা থেকে ২০১৯ সালের শেষ দিকে এসে চিত্রনাট্য লিখে ফেলেন। এরপরই টানা শুটিং করে সিনেমাটি বানান এই নির্মাতা।
View this post on Instagram
এক নজরে
রেটিং: ৭/১০
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: গিয়াস উদ্দিন সেলিম
প্রযোজনা: ইমপ্রেস টেলিফিল্ম
অভিনয়: চঞ্চল চৌধুরী, আফসানা মিমি, সিয়াম আহমেদ, শাহনাজ সুমি, মামুনুর রশীদ, ফারজানা চুমকি, গাউসুল আলম শাওন, ফজলুর রহমান বাবু ও আরও অনেকে।
সংগীতায়োজন: ইমন চৌধুরী
শিল্পী: আতিয়া আনিশা, বগা তালেব প্রমুখ
চিত্রগ্রহণ: বরকত হোসেইন পলাশ
মুক্তি: ২০ মে ২০২২
গল্প
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান খোরশেদ (চঞ্চল) এলাকার জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধি। ‘আমি হারামের টাকা খাই না’ বুক চিতিয়ে স্থানীয় সাংসদকে বলতে পারা এক নির্লোভ চরিত্র এই খোরশেদ।
বনেদী বাড়িতে তার পরিবার বলতে স্ত্রী (ফারজানা চুমকী) আর একমাত্র মেয়ে সাথী (সুমি)। তবে পরিবারে আরো দুজন মানুষ থাকেন। তাঁরা এই বাসার কাজের লোক। বাসায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা পারুল (আফসানা মিমি) আর তার ছেলে আলামিন (সিয়াম)।
আলামিনকে নিজের ডানহাত হিসাবে সবসময় সাথে রাখা খোরশেদের রাজনৈতিক জীবন গ্রামের বিবাদ আর শত্রুতা দ্বারা প্রভাবিত হয়, এটাই স্বাভাবিক। যেকোন আপদে আলামিন সবসময় খোরশেদের ঢাল হয়ে সাথে থাকে।
View this post on Instagram
তবে এই বিরাজমান ‘ইকোসিস্টেম’-এ ধাক্কা আসে আলামিন আর সাথীর প্রেমের জন্য। উঁচু আর নিচু স্তরের মানুষ হয়েও এই কিশোর কিশোরীর মনে তার কোন প্রভাব যেন পড়ে না।
আলামিনকে তার মা পারুল বারবার নিজের ‘আওকত’ দেখিয়ে দিলেও আলামিন সাথীর প্রতি দুর্বলতা লুকাতে পারে না। ধীরে ধীরে তাদের এই সম্পর্ক মাত্রা ছাড়িয়ে যায় পারুলের চোখে।
অন্যদিকে খোরশেদ চেয়ারম্যানের সাথে একটা রেলওয়ের জমির মীমাংসা নিয়ে অসন্তুষ্ট হয় এমপির (মামুনুর রশীদ) আত্মীয় (গাউসুল আলম শাওন)। এভাবেই সম্পর্কের অনিশ্চয়তা আর সামাজিক বিরোধের চাপ নিয়ে গল্প এগোতে থাকে।
সত্য একসময় সামনে আসে এই গল্পের প্রতিটি মানুষের সামনে। সত্যই বিচার করে পাপ আর পুণ্যের।
অভিনয়
চঞ্চল বলেছেন, হলে দর্শক এনে তিনি কখনো হতাশ করেননি। আমার মনে হয়, ‘পাপ পুণ্য’র খোরশেদও উপস্থিত দর্শককে হতাশ করেনি। খোরশেদের রাগী মনোভাব, রাষ্ট্রপতি পদকপ্রাপ্ত একজন চেয়ারম্যান হিসাবে ভাব-গাম্ভীর্য, একজন বাবা হিসাবে মমত্ববোধ এবং শেষ দিকে পাপবোধের মিশেলে চঞ্চল সিনেমা হলে হয়ে উঠেছিলেন সবার চোখের শান্তি।
সেলিম যতটা না অন্যদের ভেবে গল্প সাজিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি ভেবেছেন এই ‘খোরশেদ’ চরিত্র নিয়ে। আর সেটা লুক, এক্সপ্রেশন, ভয়েস মডুলেশন আর সর্বোপরি অভিনয় দিয়ে পুরোটা সময় গল্পকে বয়ে নিয়ে গেছেন চঞ্চল।
View this post on Instagram
বিরতির আগে কিছুটা গড়পড়তা লাগলেও বিরতির পর সময় যত গড়িয়েছে চঞ্চল তত মুগ্ধ করেছেন তার অভিনয় দিয়ে।
আলামিন চরিত্রটি অনেক সহজাত, পাশের বাড়ির ছেলের মতো। ‘শান’- এর মতো অ্যাকশন প্যাকড পুলিশ বা ‘পোড়ামন টু’র মতো খাঁটি রোমান্টিক হবার মতো চরিত্র আলামিন ছিল না।
সিয়াম সেটা বুঝেছেন, নিজের সাধ্য মতো করেছেন এবং তাকে অনেকটাই ভাল লেগেছে। তবে এই ধরণের ডাউন চরিত্রে অভিনয় করতে যে প্রস্তুতি ও শেখার দরকার সেটা সিয়ামকে আরও করে নিতে হবে।
চমকে দিয়েছেন নব্বই দশকের হার্টথ্রব আফসানা মিমি। কী আবেগ, কান্না কিংবা কী অভিনয় আর চাহনি, আফসানা মিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পুরো সিনেমা জুড়ে।
View this post on Instagram
গৃহকর্মী চরিত্রে অভিনয় করলেও একটা সময় তার চরিত্রে যোগ হয় বাস্তবতার ভারি আবেগ, সেটাও দারুণ উতড়ে গেছেন তিনি।
সুমী নবাগতা হিসাবে বেশ ভালো করেছে। পর্দায় তার উপস্থিতি স্নিগ্ধতা ছড়িয়েছে। স্কুলপড়ুয়া কিংবা প্রেমিকা দুই চরিত্রেই তাকে মানিয়েছে।
এর বাইরে ফজলুর রহমান বাবু, মামুনুর রশীদ, চুমকী সবাই যার যার চরিত্রে সাবলীল। গাউসুল আলম শাওনের চরিত্রটি এন্টি হিরো।
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা
‘তিব্বত নিয়ম অনুসারে
এক নারী বহু পতি ধরে।
এই দেশে তা হলে পরে
ব্যাভিচারী দণ্ড হয়।
..পাপ পুণ্যের কথা আমি
কারে বা শুধাই।’
সিনেমার একটি দৃশ্যে এভাবেই লালন ফকিরের গানটি শুনছেন খোরশেদ চেয়ারম্যান চরিত্রে অভিনয় করা চঞ্চল চৌধুরী আর তার নখ কেটে দিচ্ছে আলামিন মানে সিয়াম।
গানের সাথে তাল মিলিয়ে মুগ্ধতা প্রকাশ, খাওয়ার পর একটু সংগীতের সাথে জিরিয়ে নেয়া- এটা তো আমাদের খুব চেনা অভ্যাস।
গিয়াসউদ্দিন সেলিম আমাদের এই চেনা জগতকে নিয়েই বারবার কাজ করেছেন টিভিতে, সিনেমায়। অসংখ্যা টিভি নাটকের বিপরীতে সেলিমের বড়পর্দায় কাজ মাত্র চারটি।
View this post on Instagram
কিন্তু কখনই কাজে নিজের স্বতন্ত্রতার বাইরে যাননি তিনি। মুক্তির আগে সিনেমা নিয়ে বলেছেন, ‘বর্তমান সময়ের নানা শ্রেণির মানুষের সমাজবাস্তবতার গল্প এটি। যেখানে মানুষের ইগো ও অনুশোচনাবোধ ধরা দিয়েছে। গল্পটি সমসাময়িক এবং এর বিচরণ আছে সমাজে। আর সেটিই ধরার চেষ্টা এখানে।’
সেলিম সেটি তাঁর মতো করেই ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় সব বদলে গেলেও সেলিম এখনো সেটি আয়ত্ত্ব করতে পিছিয়ে আছেন বলে মনে হয়েছে। সেলিম নিজেও বলেছেন,
‘২০০৯ সালের বাস্তবতা আর ২০২২ সালের বাস্তবতা আলাদা। আগে একটা সিনেমা নয় মাস প্রেক্ষাগৃহে চলেছে, হল সংখ্যা ছিলো ছয়শোর মতো। এখনতো সিনেমা হলের সংখ্যা হাতে গোনা, তারপরও মাসখানেক এর বেশি একটি সিনেমা চলছে না। কিছুদিন প্রেক্ষাগৃহে চলার পর সেটা ওটিটিতে যাচ্ছে। এখনকার বাস্তবতা আলাদা। ফলে আমার কোনো চাপ নেই। সময়ের সাথে নিজেকে আপডেট করাই আমাদের কাজ।’
তবে আমার মনে হয় না চিন্তা ও কৌশলের দিক থেকে সেলিম ততটা এগোতে পেরেছেন। এখানে আলামিন আর সুমী ভিডিও কলে কথা বলছে, ‘স্বপ্নজাল’ এ শুভ্রা যোগাযোগে ব্যবহার করতো ল্যান্ডফোন আর ‘মনপুরা’র সোনাই পরীর যোগাযোগ হতো জলপথে নৌকা পেরিয়ে সামনা সামনি।
থিমেটিকভাবে সেলিম আগের জায়গাটা ধরে রাখলেও আক্ষেপ ছড়িয়েছেন ফেড আউট-ফেড ইন করে দৃশ্য বদলিয়ে। আলোর উপযুক্ত ব্যবহার না করে, ফোকাসের জায়গা ধরতে ভুল করে আর কয়েকটি চরিত্রকে শুধু একটি-দুটি দৃশ্যে এনে শুধু শুধু গল্পকে একটু টেনে আবেগঘন করা হয়েছে।
পাপ পুণ্য ছবির চিত্রগ্রহণ
বরকত হোসাইন পলাশের সিনেমাটোগ্রাফি ছবির মতই সুন্দর হয়। এর আগেও সেটা দেখা গেছে। এখানেও কাশবনের দৃশ্য, জেলবন্দী দৃশ্য ও আলামিন-সুমীর রাতের অন্তরঙ্গতার দৃশ্য দর্শকের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দারুণভাবে ক্যামেরায় ধরতে পেরেছেন তিনি।
তবে আলোর প্রক্ষেপণ আরো ভাল হলে ক্লোজ শটগুলো আরো ভাল লাগতো!
সম্পাদনা
‘পাপ পুণ্য’ অবশ্যই আগের সিনেমাগুলো থেকে সেলিমের সবচেয়ে রহস্যে রাখা সিনেমা। শেষ পর্যন্ত না দেখলে অনেক সত্যি যেমন জানা যাবে না তেমনি সিনেমার উদ্দেশ্যও জানা যায় না।
কিছুটা বোঝা গেলেও শেষ অংশের রহস্যের জন্য ভাল সম্পাদনার দরকার ছিল। মেটাফোরগুলো ধরিয়ে দেয়ার জন্য কাট করাটা ঠিক সময় বুঝে করা দরকার ছিল। খুব ভাল না হলেও সম্পাদনাকে মোটামুটি ভালো বলা যায়।
সংগীত
গানের কথা এলেই ‘মনপুরা’র কথা আসবে। শুধু গানের সিডি বিক্রিতে রেকর্ডের কথা মনে পড়বে। তবে সময় পেরিয়েছে, গানের আবেদন আর তেমন তৈরি করতে পারছে না সিনেমাগুলো।
সেলিমের সিনেমার গান সবসময় মানসম্মত, গানের কথাও হয় খুব হৃদয়স্পর্শী। তবে দর্শক অব্দি পৌছাতে যে সময় ও প্রচার দরকার ছিল সেটি হয় নি ‘পাপ পুণ্য’ তে।
ইমন চৌধুরীর মিউজিকে প্রেম আর বিরহ খুব খোলাখুলিভাবে এলেও হল থেকে বের হওয়ার সময় কাউকে গুনগুন করতে শুনিনি। তবে আমার আতিয়া আনিশার ‘তোর সাথে নামলাম’ গানটি ভাল লেগেছে।
দুর্বলতা
‘পাপ পুণ্য’র প্রথম দুর্বল দিক এর চিত্রনাট্য। গল্পটা খুব জটিল না বা অনুমান করা যাচ্ছিলো না তা নয়। সেক্ষেত্রে গল্প বলার স্টাইলটা যদি নব্বইয়ের দশকের মতো হয় তবে ২০২২ এর হাজারো কনটেন্ট দেখা দর্শকের জন্য সে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার মতই দাঁড়ায়।
আমি খারাপ বলছি না তবে আক্ষেপ করছি এই স্ক্রিপ্টটাই হয় তো আরো জমিয়ে তোলা যেত। এরপর যদি বলি, শুধু গল্প আপনাকে ধরে রাখবে এমন আত্মবিশ্বাস থাকলে গল্পকে শক্ত করতে আশপাশের বিষয় যেমন বিজিএম, কাট, কালার টোন হতে হয় খুব সাপোর্টিভ।
আরও পড়ুন:
‘নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প’ কতটুকু নিষিদ্ধ
অন্তত এ সময়ে এসে এত দুর্বল টেকনিক্যাল কম্বিনেশন দেখাটা হতাশার। আরেকটু ঘষামাজা করলে বা বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট মাথায় রাখলে ছবিটা ততটাও ঝুলে যেত না।
আর শেষে বলব, কিছু অভিনয়শিল্পীকে তেমন কোন পরিমিত জায়গা না দিয়ে অতিথি চরিত্রে আনা হয়েছে যা আফসোসের উদ্রেক করেছে বারবার।
শেষকথা
‘উত্তর আমেরিকার দর্শকদের জন্য আমার অনেক ভালোবাসা জমে আছে। আয়নাবাজি এবং দেবী সেখানে অনেক বড় সফলতা পেয়েছে, একথা সবার জানা। এবার পরিবেশক স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো কানাডা ও আমেরিকার ১১২ টি থিয়েটারে আমার নতুন সিনেমা ‘পাপপুণ্য’ মুক্তি দিচ্ছে। লিস্ট দেখে আমার মনটা ভরে গেছে।’
এই কথা চঞ্চল চৌধুরীর। পুরো সিনেমার টিমকে হলে এসেও বলতে শোনা গেছে, দর্শক যেন মুখে মুখে ছবির প্রচার করে দেয়। কিন্তু তারা হয় তো ভুলে গেছে, প্রথমবার দর্শককে হলেও আনতেও বেশ ঘটা করেই জানাতে হয়।
ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রচারণায় অপরিকল্পনা আর অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। শুধু টিভিতে কয়েকটা ইন্টারভিউ আর প্রেস ব্রিফিং করে আজকাল সিনেমা প্রমোশন হয় না। সেটা বোধহয় কর্তাব্যক্তিরা মানতে পারছেন না।
যতই বিদেশে সিনেমা মুক্তি পাক, হলে হাতেগোনা কয়েকটা দর্শক এনে দেশে সিনেমাটার বারোটা বাজানো লোকদের জন্য বেশি কিছু বলার নেই।
তারকাসমৃদ্ধ সিনেমার এমন হাল সত্যিই দেখা কষ্টের। তবে ‘লাভ ট্রিলজি’র শেষ ছবি নিয়ে আবার বলতে চাই, বর্তমান কালের নির্মাতাদের মধ্যে এখনো সেলিম পারছেন খাঁটি দেশের সিনেমাটা বানাতে।
লিখেছেন: মারুফ ইমন, লেখক ও চলচ্চিত্রকার
Leave A Comment