সিনেমাটি নিয়ে বাতচিৎ কম শুনিনি। তাবৎ সব চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসা কুড়িয়েছে। ভেনিসে পেয়েছে স্বর্ণসিংহ পুরস্কার। এবারের একাডেমি অ্যাওয়ার্ড আয়োজনেও লড়বে। সবকিছু মিলিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো কাজ হয়েছে সিনেমাটিতে। এমনটাই শুনি—আলোচনায়, তর্কে–বিতর্কে, সমালোচকদের পর্যালোচনা মারফত। তারপর একদিন সিনেমাটি দেখে ফেলি।
চলচ্চিত্র: রোমা
পরিচালক: আলফঁসো কুয়ারন
কলাকুশলী: ইয়ালিতজা অ্যাপ্রিশিও, ম্যারিনা ডি তাভিরা, ফার্নান্দো গ্রেদিয়াগা
দেশ: মেক্সিকো ও আমেরিকা
সাল: ২০১৮
রেটিং: ৪/৫
দেখার পরের অনুভূতি মিশ্র। যতটা গর্জে ততটা ঠিক বর্ষেনি।পরন্তু এই সিনেমাটিকে নিয়ে কান ঝালপালা করার মতো প্রশংসা শুনে একটা বিষয় কেবলি মনে হয়েছে। চলচ্চিত্রের বড্ড কলিযুগে বাস করছি আমরা। এমন সিনেমা ভুড়ি ভুড়ি করে গেছেন আমাদের চলচ্চিত্র করিয়ে পূর্ব পুরুষেরা। তাই এই সিনেমা নিয়ে এত হইচই ফেলে দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। তবে হ্যাঁ। চলচ্চিত্রের এই ভয়ানক ক্ষয়িষ্ণু সময়ে এমন চলচ্চিত্র নির্মাণের সাহস, ইচ্ছা আর আবেগকে সালাম জানাতেই হয়।
চলচ্চিত্রটির দুটো বিষয় আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ লেগেছে। এক. চলচ্চিত্রটির সিনেমার বলার ধরন। দুই. সেই বলার ধরনটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে অসাধারণ কৌশল গ্রহণ। এই দুটি বিষয় আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতেই এই লেখাটির জন্ম। আলফনসো কুয়ারন তাঁর চলচ্চিত্রের বলার ধরনটি বেছে নিলেন আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের আদি কবি কিংবা মাস্টার মশায়দের চলচ্চিত্র বানানোর ভঙ্গিকে। কারণ এই ২০১৯ সালে এসে আমরা এমন বলার ভঙ্গি খুব কম চলচ্চিত্রে দেখতে পাব। এই ভঙ্গিটি কেবল কিছু মাস্টার মশায়রাই করে গিয়েছেন।
এই নামের কাতারে আমরা দেখি আকিরা কুরোশাওয়া, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো আন্তেনিওনি, রবার্ট ব্রেসোঁ কিংবা আমার প্রিয় চলচ্চিত্রকার হো সিয়াও সিয়েনের নাম। মেক্সিকোর মেধাবী পরিচালক আলফঁসো কুয়ারোন তাদের বর্ণনাভঙ্গিকেই বেছে নিলেন গল্পটি বলতে। তাই তো চলচ্চিত্রটিতে আদতে আমরা কোনো গল্প দেখি না। দেখি একটি পরিবার। সেই পরিবারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনুভূতি। যা আঁতসি কাঁচ দিয়ে কুয়ারোন বড় বড় করে দেখিয়ে দিলেন আমাদের।
চলচ্চিত্রটি ঠিক ঘরের মধ্যে বসে টিভির পর্দায় দেখানো ছায়াচিত্র হয়ে ওঠেনি। মনে হবে জানালা দিয়ে দেখছি পাশের বাড়ির একটি পরিবারের নিত্য দিনের কাজকর্ম। সিনেমাটি তাই উঁচু গ্রামে কথা বলে না। কখনো কখনো প্রামাণ্যচিত্র হওয়ার ভয়ানক ঝোঁক থেকে বেঁচে যায়। পরিচালককে প্রণম্য জানাতে হয় এ কারণে যে, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মোটা দাগে গল্প বলার এই সময়ে এমন ভঙ্গিতে গল্প বলা চাট্টিখানি কথা নয়।
তাই অতি সাধারণ সব দৃশ্যগুলো রূপায়ন করার জন্য ভয়ানক কৌশল গ্রহণ করতে হলো কুয়ারনকে। এই সময়টা অনেক বেশি রঙিন। সকল জায়গাজুড়ে রঙের সমারোহ। রঙের প্রভাব বিস্তারকারী এই সময়ে কী করে সাধারণ কথা বলবেন কুয়ারন? তিনি সাহস সঞ্চয় করে চলচ্চিত্রের রঙ পরিহার করলেন। সব সেঁটে দিলেন সাদাকালোর মোড়কে।
ড্রোন দিয়ে চিত্রগ্রহণ করে ছায়াছবি অতিরঞ্জিত উজ্জ্বল করার ঝোঁক এই যুগে। যাতে অতিরঞ্জিত রঙ সিনেমার গায়ে প্রভাব বিস্তার না করতে পারে তার বন্দোবোস্ত করলেন সাদা কালো দিয়ে। তাতে কুয়ারোন উৎরে গেছেন খানিকটা। তবে আমি যদি ভুল না করি। রঙিন ফিল্টারে শ্যুট করে সম্পাদনার ঘরে সাদাকালো রঙ করায় এক ধরনের চাকচিক্য থেকেই গেছে চিত্রগ্রহণে।
বিশেষ করে অবকাশ যাপনে গিয়ে পরিবারটি যখন পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে একটি ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হেঁটে যায়। আর ফোরগ্রাউন্ডে ফুল ও গাছ আর ব্যাকগ্রাউন্ডে পাহাড়গুলো রেখে ট্রলি শট নেন কুয়ারন তখন সত্যিই কবিতার সৃষ্টি হয়। কুয়ারনকে স্যালুট এ কারণে। যতদূর জানি, এই সিনেমার ক্যামেরাও চালিয়েছিলেন কুয়ারন নিজেই।
চিত্রগ্রহণ ছাড়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্ত তুলে এনেছেন পরিচালক। যা মুহূর্তেই আপনাকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারে, ক্ষণিকের জন্য ফেলতে পারে চিন্তায়, কিংবা ভাবাতে পারে কিছুদিন। গল্পের একটি চরিত্র সেলো। সেলো হাসপাতালে একটি সন্তান প্রসব করে। প্রসব যন্ত্রণায় কাতর সে। তবু তাকিয়ে আছে সন্তানের দিকে। চিকিৎসকেরা নীরিক্ষা করে দেখছেন বাচ্চাটি নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্তে এলেন, বাচ্চাটি মৃত জন্ম নিয়েছে।
সেবিকারা বাচ্চাটিকে শেষ বারের মতো দেখতে দেয় সেলোকে। সেলো বুকের সঙ্গে মেশায় নিজের শিশুকে। তারপর দিয়ে দেয়। সেলো দেখে, নিজের চোখের সামনেই বাচ্চাটির গায়ে জড়ানো রঙিন কাপড় খুলে ফেলা হলো। সাদা কাফনে মুড়িয়ে ফেলা হলো তাঁকে। পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর রঙ মাখবার আগেই সে পড়ে নিলো সাদা পোশাক। রওনা দিল স্বর্গের সরাইখানায়। সেলোর কোন যন্ত্রণা বেশি? প্রসব বেদনা, নাকি মৃত শিশুর চলে যাওয়ার যন্ত্রণা। এমন প্রশ্নই যেন রেখে দিয়ে গেলেন কুয়ারন।
আর কোনো গল্প বলব না। এমন কিছু আছে যা বলে বোঝানো যাবে না। যা কেবল দেখেই অনুভব করা যায়।
Leave A Comment