চলচ্চিত্র: দেবী
পরিচালক: অনম বিশ্বাস
কলাকুশলী: জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, শবনম ফারিয়া, ইরেশ জাকের, অনিমেষ আইচ
দেশ: বাংলাদেশ
সিনেমা দেইখা বাইর হইলাম। লিফটে উঠব। তাড়াহুড়ো করে কোনো মতে লিফটে উঠলাম। লিফট সুন্দরী মেয়ে দিয়া ঠাসা। তাকাইয়া দেহি পোলাপানগুলো সব উপরের দিকে তাকাইয়া রইছে। ভাবলাম, আরে বাবা পোলাপান তো দেহি সেই রকমের সাধু হইয়া গেছে। সুন্দরীদের দিকে না তাকাইয়া উপরের দিকে তাকাইয়া আছে। আমিও তাকাইলাম। আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। উপরে দেখি আয়না ফিট করা, মানে গ্লাস। আমি চোখ নিচে নামাইয়া ফালাইলাম। ক্যান? কমু না। খালি মনে পড়ল, ভারতীয় একটা পত্রিকায় একটা নিউজ বের হইছে। ব্রা বিভ্রাটে কাজল, ঠিক করতে গিয়ে আরও বিড়ম্বনা। তা আবার কেডায় জানি ভিডিও করছে। এই ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল। এই পত্রিকাটা নিউজ তো করছে করছে আবার ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিও দিয়া কইছে, দেখুন ভিডিও সহ। আমি ভাবি লিফটের মধ্যে আবার সিসি ক্যামেরা নাই তো! আল্লাহ মালুম।গল্প-২
কতগুলা পোলা মাইয়া বইসা আড্ডা দিতাছে। বয়স কত অইব? ১৭ কি ১৮। হঠাত একটা মাইয়ার দিকে তাকাইয়া সবাই কইয়া উঠল হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। মাইয়া তো অবাক। আরে সবাই জানলো কী করে? বোকা মেয়ে। ফেসুবকে লেখা থাকে না! আরও অবাক করে দিয়ে বন্ধুরা ব্যাগের ভেতর থিকা কেক বাইর করল। মাইয়াটা আবেগে কাইন্দালাইলো। আমি খাড়ায়া খাড়ায়া দেখতিছি। আমার পাশে কতগুলা আরেক দঙ্গল মাইয়া আর পোলা খাড়া। একটা মাইয়া কয়, খুব খিদা লাগছে। কেকটা দেইখা খাইতে ইচ্ছা করতাসে। আমি ভাবি, খালি খালি ঢাকায় রেস্টুরেন্ট বাড়তাছে!
গল্প-৩
এফডিসির সামনে দিয়া আসতাছি। এক লোক কয় ভাই বাড্ডার কোনো বাস আছে? আমি কই, আছে হাতিরঝিলের মধ্যে বোট। লোকটা আমার দিকে ভ্যাটকাইয়া তাকাইলো। মনে মনে কয়, হালায় কয় কী? কইলাম বাসের কথা কয় বোটের কথা। লোকটা কইল, ভাই বাস নাই? আমি কই, আছে। এই সামনে গিয়া ডান দিকে বোট বাম দিকে বাস। লোকটা কয়, আপনে যাইবেন কই? আমি কই বনশ্রী। লোকটা কয়, ভাই আমারে নিয়া যান। মধ্য বাড্ডা যাব। আমি এই রাস্তা চিনি না। আপনার লগে গেলেই হবে। আমি ও লোকটা হাঁটি। পরিচয় হয়। আমার আবার শখ, কারো সঙ্গে পরিচয় হইলেই জিগাই, বিয়া করছেন? ওনারেও করলাম। কইলো, হ করছি। ছয় বছর। একটা মাইয়া। ঢাকায় থাকি। বউ সহ। আমি কই, বাবা মা আছে? উনি কয়, না। দুজনই মারা গেছে। মনটা খারাপ কইরা আরও কইলো, ভাই বড় কষ্ট দিলেন। আমার মাইয়াটা পালতাছি। বুঝতাছি বাবা মা পোলাপাইনের জন্য কত কষ্ট করে। আমি ওনার কষ্ট হালকা করার জন্য কইলাম, আমারও মা নাই। দেড় বছর হয় মারা গেছে। উনি কইলো, আমার দুইজনই নাই। আমি আর মা বাবা নিয়া কথা বাড়াই না। দুজনে গিয়ে চক্রাকার বাসে উঠি। উনি মোবাইল গুতায়। আমি ভাবি মায়ের কথা। মাকে কি উনার মতো আমি মনে করি? সত্য কথা বলতে, মনে করি না। এত এত কাজের ভীর মাকেও মনে পড়ে! এই ঢাকা বড্ড ব্যস্ত। মাকে মনে করার সময় দেয় না। বাস থামে। আমি নেমে পড়ি। উনি যাবেন উনার রাস্তায়। বললেন, ভাই, আল্লাহ ভালো মানুষের সঙ্গে দেখা করাইয়া দিছে। নইলে কিযে ভোগান্তি হইত। আমি উনার সম্পূর্ণ পরিচয় জানতে চাই। উনার নাম তসলিম হোসেন। একটা ঔষধ কোম্পানিতে চাকরি করেন।
ফুটপাত ধরে হাঁটছি। একটা ছেলে ও একটা মেয়ে কথা বলছে। মেয়েটা বেশ ঢঙ্গি। কয়েকজন তরুণ সিকিউরিটি ম্যান হেঁটে যাচ্ছে। একজন আরেকজনকে বলল, মেয়েটারে দেখলি? কেমন কেমন লাগতাছে। আমি তাকিয়ে দেখি ও মেয়ে নয়, হিজড়া।
সিনেমাটা নিয়ে বলার আগে আরেকটা সিনেমার কথা মনে পড়ল। ওই সিনেমার নাম ঘাসফুল। তৈয়ার করছেন পরিচালক আকরাম খান। গত বছর যার খাঁচা সিনেমাটা বাংলাদেশ থিকা অস্কারের জন্য পাঠানো হইছিল। মনোনীত হয় নাই। ওই সিনেমাটা দেখতে গিয়া খুব ভালো লাগছিল। কারণ সিনেমার গল্পটার মধ্যে দ্বন্দ্বটা ছিল অসাধারণ। মাতৃত্বের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব কী? তা পরে কমুনে। একটা ছেলেকে নিয়া ছেলের মা ও দাদীর দ্বন্দ্ব। ছেলের মা তার ছেলেকে নিজের কাছে রাখার দাবীদার। দাদী তার নাতির মধ্যে মৃত ছেলেরে খুইজা পাইছে। এই ছেলেরে সে আর ছাড়ব না। এই হলো গল্পের দ্বন্দ্ব। তো এই মাতৃত্বের দ্বন্দ্ব নিয়া সিনেমাটা ভালোই আগাইতেছিল। হঠাত এইটা টার্ন করল অন্যদিকে। মাতৃত্ব ফাতৃত্ব রাইখা সিনেমাটা পড়ল গিয়া আরেক ফান্দে। মানে ফোকাসটা গিয়া চইলা গেল অন্য জায়গায়। তারপর যে সিনেমাটার এই দ্বন্দ্বটা কই গেল সারা সিনেমায় তন্ন তন্ন কইরা খুঁইজা পাইলাম না। আমি নিজেই দ্বন্দ¦ খুঁজতে যাইয়া ধন্দে পইড়া গেলাম। পরিচালক কি ইচ্ছা কইরাই দর্শককে দ্বন্দ্বের ওই কেন্দ্র থেইকা সরাইয়া ফালাইছে? নাকি পরিচালক নিজেও বুঝে নাই যে, তারা যেই গল্পটা বলার চেষ্টা করছে, তার মূল দ্বন্দ্ব মাতৃত্বের। যা তাদের অগোচরেই রয়ে গেছে। কেন এই প্রসঙ্গ আনলাম, তা পরে কই। আসেন তার আগে বুঝি দ্বন্দ্ব জিনিসটা কী?দ্বন্দ্বর কথা বললে সিনেমার এক মাস্টার মশায়কে মনে পড়ে। ওই ভদ্রলোকের নাম সের্গেই আইজেনস্টাইন। উনি এক সময় থিয়েটার করতেন। পরে সিনেমা করতে আসেন। ভদ্রলোক দ্বন্দ্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে এতটাই গভীরে গিয়েছিলেন যে, গল্পের দ্বন্দ্ব তো থাকেই, সময়ের দ্বন্দ্ব এমনকি স্পেসের দ্বন্দ্ব নিয়ে কথা বলেছেন। যারা চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী, সেই সঙ্গে তাঁর দ্য ফিল্ম সেন্স ও দ্য ফিল্ম ফর্ম বই দুইটা পড়া আছে তারা সহজেই ধরতে পারবেন। একটু থিউরিটিক্যাল। আর যারা আমার মতো আম পাবলিক। তাদের জন্য বলি। গল্পের মধ্যে দ্বন্দ¦ টা হলো এই সিনেমার মতো। নায়ক নায়িকার সঙ্গে প্রেম চলছে। দুজন প্রেমে এতটাই মজেছেন যে এখন আর বিয়ে না করলে হচ্ছে না। দুজনই বিয়েতে রাজি। দুই পরিবারও রাজি। হঠাত নায়িকাকে কেউ একজন জানালো, সে যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে সেই ছেলেটি জারজ সন্তান। এবার মেয়েটি পড়ল মহাবিপদে। কী করবে সে? এই সঙ্গে আমরা যারা সিনেমার দর্শক আমরাও হায় হায় করে উঠলাম। কী করবে সে? নড়েচড়ে বসলাম। এই ছবি দেখতেই হবে। পরিচালকও এই কী করবের ফাঁদে ফেলে আমাদের ছবির শেষ পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। ছবির শেষে জানলাম, আসলে সে জারজ না। ছেলেটির বাবা তাঁকে মায়ের পেটে রেখেই মারা যায়। বিয়ের আগে তারা ছিল অন্য গ্রামে। এই গ্রামের কেউ এটা জানত না। এই যে কী করবের ফন্দিটা পরিচালক করলেন এবং আমাদের সিনেমার শেষটা দেখাইয়া ছাড়লেন, এটা হইলো গিয়া দ্বন্দ্ব।
আপনি যদি চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন, তবে আমার এই গল্প দিয়েই আপনি নেমে পড়তে পারেন দারুণ একটি ছবি বানাতে। এই ছবির গল্পগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। মনে আছে? লিফটের চরিত্রের সঙ্গে নেই তসলিম হোসেনের সঙ্গে সম্পর্ক। তবে ছবি দাঁড়াবে কীভাবে? এর ব্যাখ্যা আছে। ছবির প্রোটাগোনিস্টের সঙ্গে প্রত্যেকটা গল্পের সম্পর্ক আছে। এভাবে একটি কেন্দ্রকে ধরে কয়েকটি আলাদা গল্প যখন এগিয়ে যায় সেটাও চলচ্চিত্র হয়। চলচ্চিত্রজনেরা তার নাম দিয়েছেন অ্যান্থলোজি চলচ্চিত্র। এটাই আসলে সিনেমা সিনেমা খেলা। আমারও প্যাঁচাল পাড়া হলো, আপনারও সিনেমা বানানো হলো।
সে যাই হোক। তারপরও আমি কই এই ছবি হউক। আরও বেশি বেশি হউক। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের দেশে দুই ধরনের সিনেমা হয়। আতলামি সিনেমা আর ফাতরামি সিনেমা। অনেকদিন ধইরা আশায় ছিলাম এর মাঝামাঝি একটা সিনেমা হওয়া দরকার। যে সিনেমা আবার দর্শককে হলে নিয়ে যাবে। অত আঁতলামিও মাথায় ঢুকাতে হইব না আর ফাতরামিও দেখতে অইব না। আমার মনে হয় মাঝামাঝির সিনেমার চল শুরু অইয়া গেছে। আবার মধ্যবিত্ত হলে যাওয়া শুরু করব। বাংলা ছবি আবার বেদের মেয়ে জোসনার মতো আয় করব। তার মধ্যে কি একটা দুইটা সূর্য দীঘল বাড়ি কিংবা মাটির ময়না হইব না? হইবো। সেই আশার আলো জ্বেলে দিয়ে গেলেন নতুন এই পরিচালক ও প্রযোজক।
Leave A Comment