সুন্দর ছবি। এক কথায়। নাম শোনার পর ছবিটা দেখার খুব একটা ইচ্ছা জাগেনি। কারণ অনেকগুলো। বলিউডের চমকের ভীরে ছবিটি কেবলি সাদা পাতা। পরিচালক অখ্যাত, অভিনয়শিল্পীরা আবছা আলোকিত, আলোচনাও হয়নি। ফেসবুকে একজন ছবিটাকে ভালো বলেছিলেন। তখন ভরসা পাই। ছুটির দিনে দেখে ফেলি। সময়টা বৃথা যায়নি। উপরি পাওনাও হয়েছে অনেক কিছু। সে নিয়েই এই বয়ানখানা।
চলচ্চিত্র: নিউটন
পরিচালক: অমিত কুমার
কুলাকুশলী: রাজ কুমার রাও, পঙ্কজ ত্রিপাঠি, অঞ্জলি পাতিল
দেশ: ভারত
সাল: ২০১৭
রেটিং: ৩.৫/৫
গোড়ার দিকে শিরোনাম নিয়ে দু-চার বাতচিৎ করব। পরে যাব ছবি আলোচনায়। বলে রাখি, কেউ এই লেখাকে অকাট্য ধর্মীয় সার্মান মনে করবেন না। এ কেবলই আমার চিন্তার নির্যাস। পৃথিবীতে সত্য বলে কিছু নেই! লেখার এই নাম খানি দিয়েছি ছবির জাত চেনাতে। কারণ এই ছবিখানা ঠিক ভারতীয় চলচ্চিত্র ধারা সঙ্গে মেলে না। এ কথা এ জন্য বলছি। ভারতীয় ছবি বলতে আমরা বলিউডের এক কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকে যাই। আদতে এই ছবি খানা চকমকা বলিউডি নায়ক-নায়িকা আর অতিনাটুকেপনা নির্ভর চলচ্চিত্র নয়। তাই ছবিটি বলিউডি না হয়ে হয়ে উঠেছে ভারতীয়। ছবি যে কেবল মুম্বাইয়ের ঝলমলে বাতি দেখায় না, ভারতের সব মানুষের কথা বলে উঠে, ‘নিউটন’ তার ছোট্ট প্রমাণ। তবে এমন ছবি যে ভারতে হয় না এমনটি নয়। দুঃখ শুধু, পত্রিকার পাতায়, বক্স অফিস জোয়ার, মানুষের মুখে-কোথাও এর নাম পাওয়া যায় না। তকমাই লেগে গেছে, এগুলো উৎসবে পাঠাতেই বানানো হয়। তাই প্রযোজকদের দিক থেকেও প্রচার থাকে কম, দর্শকেরাও মনে করেন ‘ইহা তাহাদের বোধগম্য হইবে না’। পরিচালকেরাও কাছাকাছি ভাবেন। এই মারপ্যাচে ভালো ছবিগুলো ক্রমশই দর্শকের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর দর্শকেরাও আমরা। নিজেদের ঘাম মেশানো ছবিগুলো দেখতে বড্ড ক্লান্তি লাগে। অবশ্য লাগবে না কেন? সারা দিনের ক্লান্তি শেষে সিনেমা হলের ওই পরিবেশটুকুতে বাইজি নাচের আনন্দ পেতেই তো যাই। ওখানেও জীবন ঢুকে গেলে ক্যামনে কী? এটাই এই উপমহাদেশের দর্শকের ঐতিহাসিক নিয়তি। কেমনে? সে আরেক বাতচিতে বলা যাবে।
ছবির গল্প সরল। ছত্রিশগড়ের গহীন জঙ্গলে নৃগোষ্ঠী এক গ্রাম। মাওবাদীদের আস্তানা সেখানে। নির্বাচনী এলাকাও সেটি। ভোট নিতে সেখানে যান ছবির নায়ক নিউটন। মা বাবার দেওয়া নতুন কুমার নামকে নিউটন নাম দিয়েছেন নিজেই। সেনাবাহিনীর সাহায্যে নিউটন সেখানে যান ভোট নিতে। ভোট নেন, সাংবাদিকেরা যায়, নিউজ হয়, ভোটও দেন নৃগোষ্ঠী মানুষেরা। ছবি এভাবেই শেষ হয়।আপনি বলবেন, এর মধ্যে এমনকি আছে? যা এমন আহামরী? আমারও প্রশ্ন সেখানে। আমাদের দেশটাও তো এমনই চলছে। এর মধ্যে এমন আহামরী কী ব্যাপারখানা? তাই বাস্তব জীবনেও এসব বিষয় নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলি না। কিন্তু ছবি প্রশ্ন তুলে দেয়। এখানেই ব্যাপার। নিউটনকে যখন সেনাবাহিনী কমান্ড্যান্ট মাওবাদীদের ভয় দেখিয়ে নির্বাচনী বুথে যেতে অনাগ্রহী করতে চায়, তখনই আমাদের চোখ আটকে যায়, কান হয় খাড়া। পাহাড়ে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম আস্তে আস্তে খুলে যায়। গভীর জঙ্গল পেরিয়ে যে স্কুলটি পরিচালক আমাদের দেখান, তা দিয়ে আমরা বুঝতে পারি, পাহাড়িদের অবস্থান। পুরো ছবিতে যাদের ভোট নেওয়া হবে, তাদের কোনো হদিস পওয়া যায় না। একটু একটু করে দেখা দেয়। মনে হয় যেন ছবির ভেতর থেকেও নেই। যেমনটি পুরো দেশে ঘটে। এরপর ভোট নেওয়া শুরু হয়। ভোট কার্যক্রম দেখতে আসেন উপরস্থ কর্মকর্তা। সম্পূর্ণ কার্যক্রমে ধরা দেয় পুরো ভারত রাষ্ট্রটি। রাজনীতি, সেনাবাহিনী, সাধারণ অফিসার, নৃগোষ্ঠী। চতুর্মুখী মিথস্ক্রিয়ায় ঘটতে থাকে একেকটি ঘটনা। সেখানে নিউটন এসে ধরা দেয় সৎ অফিসার হিসেবে। ছবির বাস্তবিকতায় তাকে সৎ অফিসার হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে নিউটন ধরা দেয় রাষ্ট্রের প্রগতিশীল মুখ হিসেবে। যেখানে সেনাবাহিনির কমান্ডার ভোট শেষ হওয়ার আগেই মাওবাদী হামলার নাটক করে ভোট কেন্দ্র থেকে সবাইকে বের করে আনে, সেখানে এই নাটক বুঝতে পেরে নিউটন বন্দুক কেড়ে নিয়ে কমান্ডারকে জিম্মি করে শেষ সময় পর্যন্ত ভোট নিয়ে নেয়।
তবু এটি খারাপ ছবি নয়। পেছনের কারিগরেরাও যে ভালো ছবিই বানান। ছবিটি প্রযোজনা করেছে দৃশ্যম। মাসান দিয়ে তারা পরিচিত। পরিচালক অমিত মাসুরকর। সোলেমানি কেদা দিয়ে নাম রেখেছেন আগেই। আর রাজ কুমার রাও ও অঞ্জলি পাতিলের নতুন করে ভক্ত হয়ে গেলাম।
বলে রাখি বিতর্কও ছিল ছবিটি নিয়ে। ইরানি পরিচালক বাবাক পায়ামির সিক্রেট ব্যালট এর নকল অনেকে বলেছেন। এই বিতর্কে পাশে দাঁড়িয়েছেন আরেক ভারতীয় পরিচালক অনুরাগ কশ্যাপ। বাবাকের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা এই মত দিয়েছেন যে, ছবিটি নকল নয়। অনেক আগে সিক্রেট ব্যালট ছবিটি দেখেছিলাম। কাহিনির একটু আধটু মিল থাকলেও দুটোর প্রেক্ষাপট যে আলাদা সে বলতে পারি। নকল হোক কিংবা একই দেখতে, ‘নিউটন’ যে এই সময়ে বলিউড বাজারে ধাক্কা দেওয়া একটি ছবি সে বলা যায়।
নিউটন অফিসিয়াল ট্রেইলার
Leave A Comment