অ্যানিমেশন ছবি নিয়ে সবার একটা সাধারণ ধারণা আছে। রূপকথার রাজ্যের চটপটে সুন্দরীদের নিয়েই যেন অ্যানিমেশনের কাজ কারবার। অদ্ভুত আকৃতির চরিত্র নিয়ে কমেডিতে ঠাসাও অ্যানিমেশনের আরেক প্রকৃতি। তবে একটি কথায় প্রায় সবাই-ই একমত হন। সেটি হলো-অ্যানিমেশন ছোটদের ছবি। প্রথাগত সেই চিন্তাকে থাপ্পর মারল জাপানি ছবি ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’।
চলচ্চিত্র: স্পিরিটেড অ্যাওয়ে
পরিচালক: হায়াও মিয়াজাকি
কলাকুশলী: রুমি হিরাগি, মিউ ইরিনো, মারি নাতসুকি
দেশ: জাপান
সাল: ২০০১
রেটিং: ৩.৫/৫
পরিচালক: হায়াও মিয়াজাকি
কলাকুশলী: রুমি হিরাগি, মিউ ইরিনো, মারি নাতসুকি
দেশ: জাপান
সাল: ২০০১
রেটিং: ৩.৫/৫
চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখে যারা মনে করেন, এ কেবল কমেডিই, তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। স্টুডিও গিবলির ছবিগুলোও তেমনি। পুরনো ধাচের অ্যানিমেশন। অত রঙচঙাও নয়। গল্পেও আছে অদ্ভুত সব কান্ড। তবু বাস্তব জীবনের অসাধারণ কথাগুলো একে একে বলে যায়। ২০০১ সালের জাপানি ছবি ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ দিয়ে হায়াও মিয়াজাকি তাই করে দেখালেন। ছবিটি নিয়ে বলার আগে, বলে নেই। আমার অ্যানিমেশনের প্রতি কোনো দুর্বলতা ছিল না। আমিও ভাবতাম অ্যানিমেশন মানে ছোটদের ‘টম অ্যান্ড জেরি’। সে ভুল ভাঙালো এই ছবিটি।
প্রথমেই চমকে গিয়েছিলাম। আজদাহা সব চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রায়ই নাম দেখতে পেতাম ছবিটির। খোঁজ নিয়ে জানি, এটি অ্যানিমেশন। আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। একদিন ভাবি, ‘টাইটানিকে’র মতো ছবিকে টেক্কা দিয়ে জাপানে যে ছবিটি বেশি আয় করে নেয়, আর যা হোক সে ছবিটিকে দেখতেই হবে। একদিন ঠিকঠাক বসে পড়লাম। তারপর শুধুই মুগ্ধ হওয়ার পালা।
ছবিটি সম্পর্কে বলার আগে একটু প্যাঁচাল পেড়ে নেই। আপনারও ভালো লাগবে আশা করি। ৭৫তম অস্কার আসরে সেরা অ্যানিমেটেড ছবি হিসেবে পুরস্কার পায় এটি। জাপানের বেশি আয় করা ছবিগুলোর একটি। ২০০২ সালের বার্লিন্যালে ‘ব্লাডি সানডে’র সঙ্গে গোল্ডেন বিয়ার পায়। রেটিংয়ে রটেন টমেটো, আইএমডিবিসহ সবজায়গায়ই উপরের দিকে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের করা ‘বেস্ট ফিল্ম ২১ সেঞ্চুরি সো ফার’ তালিকায় এটি দ্বিতীয় ছবি। এতসব অর্জন ছবিটিকে ঘিরে। এই ছবি শুধুই একটি অ্যানিমেশন ছবি নয়, দিব্যি।
ছবির গল্প বলব না। এইটুকু বলি, এর মূল চরিত্র চিহিরো। দশ বছরের জাপানি এক ত্যাড়া মেয়ে। বাবা মায়ের সঙ্গে যায় বাড়ি খুঁজতে। ভুল পথে তাঁরা ঢুকে পড়ে বনে। হাজির হয় এক টানেলের গেটের সামনে। আসলে সেটি পুরাতন এক অ্যামিউজমেন্ট পার্কের গেট। চিহিরোর বাবা ও মা ঢুকে পড়ে। চিহিরো ত্যাড়ামি করে। যাবে না সে। অতঃপর ঢুকে পড়ে তিনজনই। ঢোকার পরই গল্প শুরু। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক হয়ে তারা হাজির হয় এক অদ্ভুত জায়গায়। সেখানে এক কল্পরাজ্য বানিয়েছেন মিয়াজাকি। এটা একটা হাম্মামখানা। যেখানে আত্মারা গোসল করতে আসে।
এই পুরো হাম্মামখানা চালাচ্ছে ইউবাবা নামে এক ডাইনি। এই হাম্মাখানায় মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। সেখানেই তারা ঢুকে পড়েছে। সারি সারি দোকানে খাবার দেখে লোভ লেগে যায় চিহিরোর বাবা-মায়ের। তারা শুয়োরের মতো খেতে থাকে। এক পর্যায়ে শুয়োর হয়ে যায়। একা হয়ে যায় চিহিরো। সে দেখে আস্তে আস্তে সেও শুয়োর কিংবা আত্মায় রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। কীভাবে সে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। বাবা-মাকে বাঁচাবে। কে তাঁকে সাহায্য করবে? এই দ্বন্দ্ব নিয়ে এগিয়ে যায় ছবিটি।
আসলে আমি যতটুকু বললাম, এ কেবল ছবির শুরু। তারপর ঘটে অসাধারণ সব ঘটনা। তবে সেই ঘটনার থেকে যেটি আমার কাছে চোখে বেশি করে ধরা দেয়, সেটি মিয়াজাকির শিক্ষকতা। অ্যানিমেশনের আড়ালে এই স্বার্থপরতার সময়ে কী করে দশ বছরের একটি মেয়ে নিজের মূল্যবোধ, পরিশ্রমী মানসিকতা, পরোপকারিতা শেখে, তারই এক বয়ান দিলেন মিয়াজাকি। পুরো হাম্মামখানা জুড়ে বিভিন্ন মানুষের বসবাস। তারা প্রায় সবাই-ই নিজ নিজ স্বার্থের জন্য কাজ করে। এমনই একটি পরিবেশে এসে পড়ে জেদি চিহিরো। প্রশ্ন দাঁড়ায়, চিহিরো কি ওদের জীবন যাপনই শিখে নিবে? নাকি একের পর এক লড়াই করে নিজেকে মানুষ হিসেবেই গড়ে তুলবে।
এই প্রশ্নের উত্তর সারা সিনেমাতে দিয়ে রেখেছেন পরিচালক। তাই, এই ছবিটি শুধুই অ্যানিমেশন হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে পরিণত ছবি। ছবির চরিত্রটি কেন মিয়াজকি ১০ বছরের শিশুকে রেখেছেন? তার একটা উত্তর আমার কাছে ধরা দেয়। আমার মনে হয়েছে, এই সময়টি একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময়। জীবনের একটি পরিবর্তন শুরু হয়। কৈশরের আলাভোলা থেকে সে শিখতে শুরু করে বাস্তব জীবনের কাঠিন্য।
তাঁকে প্রতি পদে পদে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। চিহিরো যেমন এক আজব জায়গায় এসে একাই সিদ্ধান্ত নেয়, বাস্তবেও বয়সন্ধিকালে পড়তে যাওয়া একটি মেয়েকে নতুন পৃথিবীতে সিদ্ধান্ত নিতে শিখতে হয়। তাঁকে জানতে হয় পৃথিবীকে, এই সময়কে, এই সময়ের মানুষদের। মিয়াজাকি একটি কল্পরাজ্যের রূপকথা দিয়ে বর্তমান সময়কেই যেন চিনিয়ে দিলেন। মিয়াজাকি বলেছিলেন, আসলে ১০ বছরের শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট করে বানিয়েছিলেন ছবিটি। এ জন্যই এত শক্তিশালী প্রভাব পড়ে বড়দের মনেও। কারণ সবার উদ্দেশে বানানো সিনেমা আসলে কারও জন্যই বানানো হয় না।
মিয়াজাকির সিনেমার খুঁটিনাটি নিয়ে এবারে বলছি না। কারণ মিয়াজাকির ওপরে পড়ালেখা আমার কেবলই ধারাপাতের অ আ ক খ। স্নাতক না হয়ে কারো সম্পর্কে কিছু বলা যায়?
Leave A Comment