প্রতিদিন কুপ থেইক্যা পানি নিয়া আস। আর ঘরের মধ্যে আলু খাও। সারা সিনেমা জুড়ে এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনার ঘুম তো পাইবোই। মেজাজও খারাপ হইতে পারে। তবু সিনোমটা নাকি বার্লিন চলচ্চিত্র উতসবে স্বর্ণ ভল্লুক পাইয়া বইসা রইছে। পাইবোন না কেন? এই সিনেমা নাকি বানাইছে বেলা তর।

চলচ্চিত্র: দ্য তুরিন হর্স
পরিচালক: বেলা তর
কলাকুশলী: ইয়ানস দার্জসি, এরিকা বক, একটি ঘোড়া
দেশ: হাঙ্গেরি
সাল: ২০১১
রেটিং: ৪/৫

হাঙ্গেরির এই পরিচালক ২০১১ সালের পর সিনেমা টিনেমা রাইখা পুরো দস্তুর ঘুইরা বেড়াইতেছে। সে যাই হউক সিনেমা খান দেইখা আমার মতো আপনার মনে হইতে পারে এইডা কোনো সিনেমা হইলো? তারপরও সিনেমা খান দেখছি। লেখতেও বসছি। তার একখান কারণ তো আছে। কী কন?

সিনেমা দেইখা এইডা বোঝার জন্য পড়ালেখা শুরু করলাম। যা পাইলাম তার মোদ্দাকথা খাড়ায়, এই সিনেমার লগে নিতসে নামে এক ভদ্রলোক জড়িত আছেন। এমনিতেই ভদ্রলোক খুব পেচাইন্না। তার একখান বই আমি জরথুস্ত্র বলছি বইটা কয়বার যে ধরছি আর কয়বার যে রাখছি, তার ইয়ত্তা নাই। তবু বইখান পইড়া উঠতে পারি নাই। তো এই ভদ্রলোক যেই সিনেমার সঙ্গে জড়িত সেইটার মধ্যে যে বারবার আলু খাওয়ার দৃশ্য দেখতে অইব এতো স্বাভাবিক।

রাগ কইরেন না। পেচাইন্না হওয়ার একটা কারণ হইলো এই নিতসে নামের জার্মান ভদ্রলোক হইলো দার্শনিক। তাই তার কথায় যেমন আমগো আম পাবলিকগো প্যাঁচ লাগে উনি জড়িত যে সিনেমায় সেই সিনেমায়ও প্যাঁচ লাগে। তাইলে এই প্যাঁচ লাগাইনা সিনেমা লইয়া আবার এত চিক্কইর পাক্কইর করার দরকার টাকি? আছে রে ভাই আছে। এইডাতো আর এমনে এমনেই সোনার ভাল্লুক পায় নাই। হ্যাতের মধ্যে আছে কিছু একটা।

সিনেমার প্রথমেই নাকি নিতসে মহাশয় কী করছেন এই নিয়া কথাবার্তা আছে। তয় আমি কিন্তু অতকিছু বুঝি নাই। সিনেমায় আবার কথাবার্তার চাইতে দেখার দিকে আমার আবার মনযোগ থাকে বেশি। এমনিতেই ইংরেজিতে দুর্বল। বিদেশি সিনেমাতো আবার সাবটাইটেল ছাড়া বোঝন যাইব না। সবকিছু ধইরা আমার ভরসাই অইলো সিনেমার দৃশ্যকল্প। তয় এই সিনেমায় কি এমন কিছু আছে? আছে রে আছে। আহেন অই বিষয় আশয়গুলা লইয়া কথা কই। নিতসেরে বুঝি না হ্যাতেরে লইয়া আজাইরা টানাটানি করলে চলব। বেলা তর জানেন না? নিতসে জানে না এমন কোটি কোটি মানুষ এই দুনিয়ায় আছে। তাগো কি সিনেমাখান বোঝার দরকার নাই? আপনেরা যারা আমার মতো আম পাবলিক তাগো বলি আমাগে নিতসে জানার দরকার নাই। এমনিতেই ছবিখানা তর সাহেব এমন জাদু দিয়া বানাইছে আপনাকে বুঝতে অইব না।

এমনিতেই মনের মধ্যে ছবিখানার মর্মার্থ সুরুত কইরা ঢুইকা যাইব। যারা আঁতলামি করতে চায় হ্যাতেরা এই ছবির লগে নিতসে টিতসে লইয়া ত্যানা প্যাঁচাইয়া শেষ কইরা দেছে। ওই রিভিউ পইড়া উল্টা আরও মাথা খারাপ হইবার জোগাড়। তয় এই ছবিখান লইয়া বেলা তর সাহেবের একখান সাক্ষাতকার পড়ছিলাম। ওই খান কিন্তু কাজে দেসে। নিতসে টিতসে দেইখা আমি ভাবছিলাম সিনেমাখান নিয়া তাইলে অবুঝই থাইকা গেলাম। পরে সাক্ষাতকার পইড়া দেহি আমি যা বুচ্ছি বেলা তর সাব তা-ই বলবার চাইছেন। যদিও প্রত্যেক আর্টই তখনই আর্ট হইয়া উডে যখন দর্শক তার মতো করে বুইঝা নেয়। তাই এই ছবিও আমি আমার মতো কইরা বুইঝা নিলাম। সেইটা আবার আপনাগো লগে ভাগাভাগিও করলাম।

এই সিনেমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণের জায়গা ধুম ধারাক্কা এডিটিং নাই। এখনকার সিনেমা দেখলে চোখের পলক ফেলা যায় না। তার আগেই চারবার কাটিং। এত শট কাটলে দম ফেলা যায়রে ভাই। এই শট নিচে তো মুহুর্তে চইলা গেছে উপরে। এই ট্রলি তো আবার ড্রোন। আপানারে অস্থির কইরা রাখবো। বেলা তর সাহেব এই জায়গায় নিয়া আসছেন চরম প্রশান্তি। মাত্র ৩০ খানা শটে পুরো আড়াই ঘণ্টার সিনেমা বানাইছেন। বোঝেন অবস্থা। তার মানে কোনো কাট নাই। শটের শুরু আর শেষ আছে। পাত্র পাত্রী মাত্র তিনজন। বিশ্বের তাবত ফিল্ম জার্নালগুলোতে কুশীলবদের নামের জায়গায় শুধু মাইনষের নাম লেখা থাকে। এই সিনেমা দেইখা আমার মনে হইলো শুধু মাইনষের না বেলা তরের সিনেমার কুশীলবদের নামের সঙ্গে ঘোড়াটার নামও রাখতে অইব। ঘোড়া দিয়া অভিনয় করানো সম্ভব কি না জানি না।

তবে ঘোড়ার আচরণগুলো দিয়ে এমন একটা অবয়ব দাঁড় করাইছেন পরিচালক সাহেব ঘোড়াও সারা ছবির মধ্যে পাক্কা একটা চরিত্র হইয়া খাঁড়াই রইছে। কেন ঘোড়ারে অভিনশিল্পী বানাইতে অইব তা বেলা তর নিজেই সাক্ষাতকারে কইছে। তার কাছে নাকি লোকেশনটাও একটা অভিনেতা। তাই সিনেমা করার আগে লোকেশন খোঁজাই একটা বড় কাজ তার কাছে। বাকি থাকে দুজন। একজন বাবা। একজন মেয়ে। তারা কথা কয় খুব কম। কাজ থেকে ফেরার পর মাইয়াটা বাবার জামা কাপড় খুলে দেয়। বাবার আবার এক হাত কাজ করে না। পঙ্গু বলতে পারেন। এরপর মাইয়াটা আলু সেদ্ধ করে। আলু সেদ্ধ হইলে মাইয়াটা শুধু বলে কিস। মানে খাবার রেডি। বাবা ও মেয়ে খায়। তাদের মধ্যে কোনো কথা হয় না। একটা নির্জন জায়গায় এই দুই বাবা মেয়ে থাকে। মাঝে একজন লোক আসে। একটা বেদুইন দল আসে। কিন্তু সারা সিনেমায় তাদের উপস্থিতি এক ঝলকের মতো।

তাইলে সিনেমায় আপনি কী দেখবেন? গল্প কী? অই যে, বাবা কাজ থেইকা ফিরব। আর মেয়ে আলু সেদ্ধ করে খাওয়াইব। প্রতিটি দৃশ্যেই আপনি একই জিনিস দেখবেন! বোরিং হইবেন না? আপনি না হইলে বুঝতে হবে আপনি এলিয়েন গোছের কিছু। কারণ কলকাতায় একটি চলচ্চিত্র উতসবে সিনেমাখান দেখানোর পর ৮০ ভাগ লোক মাঝপথে উইঠা গেছে। বাকি ২০ ভাগে মনে করি আয়োজক ও ফিল্মের শিক্ষার্থী ছিল মনে হয়। যাদের একটি এলিয়েন সুলভ গোয়ার্তুমি আছে সিনেমা দেখার। কারণ পড়ালেখার ব্যাপার স্যাপার তো। গণিত যতই খারাপ লাগুক করতে অইব। যাউক বোরিং হইয়া আপনি উইঠা যাইবেন। তাই না? আমি বলি কি, বেলা তর সাব এইটাই চাইছিলেন। আপনি বোরিং হন।

প্রতিদিনের যে একই গতানুগতিক বাধা জীবন, এই বিরক্তিকর জীবনের দর্শনই দিতে চাইছেন পরিচালক সাহেব। সুতরাং বোরিং হলেই বরং তিনি সার্থক। প্রতিদিনের এই রুটিন মাফিক জীবন কতটা ভয়ংকর তা বেলা তরের লং শট ও স্তদ্ধ হয়ে বাবা মেয়ের আলু খাওয়ার দৃশ্যে ছাড়া আর কোথায় পাবেন আপনি? এইখানেই তিনি মহান। সিনেমাখানা হয়ে ওঠে ধ্রুপদি। সবশেষ একখান কথা কই, আমরা সিনেমায় সবকিছু বক্তব্য দিয়ে কইতে চাই। বেলা তর সাহেব দৃশ্যকল্প সাজিয়ে মগজে ঢুকিয়ে দেন। বক্তব্য বলতে হয় না। জানেন তো। যে সিনেমায় যত বেশি বক্তব্য তা ততবেশি পঁচা। যে সিনেমা যত বেশি বক্তব্য বর্জিত ও সহজ তা ততবেশি শৈল্পিক। ওমা জাফর পানাহিকে দেখেন না। কেমন সিনেমা আর বাস্তবতা এক কইরা প্যাঁচ লাগাইয়া দেয়। এইটা সিনেমা, নাকি হাচাই-বোঝা দায় হইয়া পড়ে। যেখানে গুরুভার কম সেখানেই আনন্দ যে। রবিবাবুর ভুলস্বর্গ পড়ছেন না?