একটি চলচ্চিত্র যখন মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় হত্যাকারীর পরিবার ও হত্যাকৃতের পরিবারের সদস্যদের। সেই চলচ্চিত্রে কি সংলাপ লাগে? লাগে কোনো কাল্পনিক গল্প? জশুয়া ওপেনহেইমার ঠিক বলেছেন, তিনি শুধু একজন গল্পবলিয়ে নন, নিজেকে ভেঙেচুড়ে দেখন তিনি। তার প্রামাণ্যচিত্রের চরিত্রও যেন দাঁড়িয়ে যায় নিজের পরিচয়ে। শুধু একটি গল্প বলে না। পরিবেশ সৃষ্টি করে দর্শককে বাধ্য করে পরিস্থিতি বুঝতে।

দ্য অ্যাকট অব কিলিং (২০১২)
দ্য লুক অব সাইলেন্স (২০১৪)
পরিচালক: জশুয়া ওপেনহেইমার

গল্পটা ইন্দোনেশিয়ার। ১৯৬৫-৬৬ সালে ইন্দোনেশিয়াতে ঘটে জঘন্য হত্যাযজ্ঞ। সেনা সরকারের যেই বিরোধিতা করে তাকেই কমিউনিস্ট, ভুমিহীন কৃষক, প্রগতিশীল, ইন্টেলেকচুয়াল বলে মেরে ফেলে। ওরা ধর্ম মানে না। এমন কথা বলে জনগণের মধ্যে গড়ে তোলে এই বিপ্লবীদের বিরোধী মানস। সেই হত্যাকান্ড ঘটানোয় নেতৃত্ব দেয় ‘পঞ্চশিলা’ নামে একটি বাহিনী। যারা স্বাধীন মানুষ নামে পরিচিত এবং আজকেও ইন্দোনেশিয়ান সরকারের নেতৃত্বে।

এমন একটি সময়ে জশুয়া নির্মাণ করেন তাঁর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘দ্য অ্যাকট অব কিলিং’ ও ‘দ্য লুক অব সাইলেন্স’। প্রথম প্রামাণ্যচিত্রে জশুয়া খুব চালাকি করে সেই হত্যাযজ্ঞের নেতাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন কীভাবে হত্যা করেছিল তাঁরা। এই অভিনয়ের মধ্য দিয়ে জশুয়া হত্যাকারীদের মানসিকভাবে নিয়ে যেতে চেয়েছেন সেই সময়ে। সেটা ধুর্ততার সঙ্গে পেরেছেন তিনি। অভিনয়ের সময় তাদের এক্সপ্রেশন বলে দিচ্ছিল কত জঘন্য কাজ করেছেন তারা। প্রামাণ্যচিত্রের শেষের দিকে এক হত্যাকারীর কথা বলতে বলতে বমি করে দেওয়া অত্যন্ত তাই বলে। কিন্তু এই বোকা হত্যাকারীরা বুঝতে পারেনি অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাঁরা কী বলে যাচ্ছেন। যদিও তাদের এত ভাবার দরকার হয় না। কারণ তারা এখন ক্ষমতায়। আর সেই হত্যাকান্ডের ঘটনাতো বীরত্ব গাঁথা। কমিউনিস্ট মারাতো একটা সোয়াবের কাজ। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি সময় পাল্টেছে। দর্শক এখন শুধু গল্প দেখে না। সঙ্গে সঙ্গে পরিচালক শুধু তাদের বীরত্ব গাঁথা দেখাননি। তাদের মুখ থেকেই শুনিয়েছেন নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা। প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ শেষ হয় ২০১২ সালে।

২০১৪ সালে নির্মাণ করেন দ্বিতীয় প্রামাণ্যচিত্রটি। এটা আরও দারুণ। এক হত্যাকৃতের ভাই একে একে দেখা করেন তাঁর ভাইকে হত্যাকারীদের পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে। ক্যামেরার সামনেই ধরা দেয় দুটি পরিবারের সদস্যদের আবেগ-অনুভূতি। এখানেই প্রামাণ্যচিত্রটি সার্থক হয়ে যায়। বলে রাখি, এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুধু ক্যামেরা আর ক্রু দিয়ে চলে না। সাহস লাগে। হত্যাকৃতের পরিবারের সদস্যকে প্রোটাগনিস্ট করে যে হত্যাকারীদের সামনে দাঁড় করিয়েছেন, সেই হত্যাকারীরা এখন ক্ষমতায়। ক্যামেরার সামনেই হুমকি দিচ্ছেন। এখনও তাহলে কমিউনিস্ট কার্যক্রম চলছে। তাহলে অতীতের ঘটনা আবার ঘটবে।

এখানে প্রামাণ্যচিত্রও নিজে জীবনের একটা অংশ হয়ে যায়। চলচ্চিত্র এবং জীবন একাকার হয়ে যায়। ঠিক যেন জাফর পানাহির ‘দ্য মিরর’ ছবির মতো। যেখানে চলচ্চিত্র-জীবন ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়।